সেই জোনাকিরা (১–৩) ৷৷ অনিরুদ্ধ সেন

18 09 2012

There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the first.

হরিষে বিষাদে

না, খুলনার ভৈরব নদের কিনারে পয়োগ্রাম নামের যে অকিঞ্চিৎকর গ্রামে আমাদের পারিবারিক ভিটে, যেখানে পশ্চিমবাড়ির ঈশান কোনের ভাঙা দেউলের পেছনে ঝুরিসর্বস্ব অশ্বত্থের নিচে আমার তামাম পূর্বপুরুষের নাড়ি পোতা, সেখানে জন্মাইনি আমি৷ আজীবনের বৃন্দাবন শা’গঞ্জেও না৷ জন্মসুত্রে মহানাগরিক, খাস কলকাতায় জন্ম আমার৷ নাগরিকের অন্য এক অর্থ বিদগ্ধ বা রসিক — আদি ও অকৃত্রিম অমর কোষ, অভাবে হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ দেখে নেবেন! আমরণ সেই বিস্মৃত অর্থের মহানাগরিক থাকতে চাই পাঁচ জনের শুভেচ্ছায়৷

তখন যুদ্ধ শেষ৷ বাবা (আর্যকুমার ) চেয়েছিলেন কোহাটের (অধুনা পাকিস্তানে) জয়েন্ট সর্ভ়িসেস হাসপাতালে আমার শুভাগমন হোক৷ তিনি তখন সেখানে বিমান বাহিনীতে কর্মরত; সদ্য রাজকীয়তা ঘুচে বাহিনী তখন শুধুই ভারতীয়৷ তাও আমার কপালে ছিলনা, কারণ, জন্মের কয়েক মাস আগে যুদ্ধকালীন শর্ট-সর্ভ়িস কমিশনের অফ়িসর, দু’নম্বর স্কোয়াড্রনের নেতা, পিতৃদেবকে তদানীন্তন সরকার বাহাদুর আরব্য উপন্যাসের জিন-পরির মত নিচের জবর জবর তিন বরের যে কোনও একটা বেছে নিতে বলেন:

(এক)  স্বক্ষেত্রে পাকাপাকি কমিশন,

(দুই)   কর্তৃপক্ষের সুবিধেমত তুল্যমূল্য অন্য কোনও সরকারি কাজ, অথবা

(তিন) পূর্ণ স্বরাজ৷

আমাদের পরিবারে, একটু আধটু ফুটানিই যা ছিল (রবিবার সকালে আকাশ ভেঙে পড়লেও লুচি হত, সিভিলিয়ান জীবনে বাবা সর্বদা ধোপদুরস্ত সাদা ধুতি পঞ্জাবি পরতেন — প্যান্ট শার্টের চেয়ে সস্তা বলে), বসে খাবার মত রেস্ত ছিল না৷ তায় আবার তখন সদ্য সদ্য যুদ্ধ শেষ হয়েছে, ওদিকে নিজের সংসার হয়েছে, একটি সন্তান হব হব৷ তিনি স্ববুদ্ধিতে পার্মানেন্ট কমিশনের হাতছানি উপেক্ষা করে, বাকি দুই বরের আপেক্ষিক ওজন যাচাই করতে, দিল্লির পতৌদি হাউসে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে মাকে রেখে এলেন কলকাতার বাড়িতে৷

দুটো সুযোগ তাঁর সামনে সহজে এলো: বিশ্বযুদ্ধের পিঠোপিঠি, অশালীন ইয়ার্কির মত সেই ধর্মীয় সংঘাতের আবহাওয়ায়, আকাশবাণী ঢাকার স্টেশন ডিরেক্টরের পদ (বাবার জবানিতে, “অভ় অল প্লেসেজ়…!”) এবং, স্বচেষ্টায়, কলকাতার চল্লিশ মাইলের মধ্যে নাতিবৃহৎ, কিন্তু যুদ্ধাবকাশে ক্রমবর্ধমান এবং যুদ্ধান্তেও সম্ভাবনাময়, এক বেসরকারি কারখানায় জনৈক মানবসম্পদ আধিকারিকের দায়িত্ব, যদিও গালভরা সেই পদনাম তৈরি হয়নি তখনও৷ স্বভাবতই, প্রথমটাকে উপেক্ষা করে তিনি নিজের স্বকীয় মেধা, অধীত বিদ্যা এবং অর্জিত অভিজ্ঞতার অনুপযোগী সেই মফসসলের বৃত্তিটাই বেছেছিলেন; হাতে সময়ও ছিল না৷

উনিশশো ছেচল্লিশের পয়লা নভ়েম্বর তিনি কাজে যোগ দেন; সেই আঠেরোই মায়ের ডাক্তার শ্বশুরের হাতে আমার জন্ম — হাসপাতালে নয়, তাঁরই কলকাতার বাসায়, মায়ের নিভৃত শয়নকক্ষে৷ অন্য চোখে দেখলে, রুশদি যাদের মধ্যরাত্রির সন্তান  বলেছেন, রূপকার্থে তাদের চেয়ে আমি এক গর্ভবাসকাল বড় — নিঃসন্দেহে বেবি বুমারদের একজন৷ তার কিছুদিন পরই নবজাতকসহ মাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেয়া হয়, শ্রীপল্লিতে, তাঁর দাদামশাই-দিদিমার কাছে: হয়ত লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক এবং ন্যক্কারজনক রক্তক্ষয় এড়াতে, হয়ত মায়ের শরীর সারানোর জন্য৷

শান্তিনিকেতনেই বিয়ে হয়েছিল মায়ের, বীরেনদার বাড়িতে৷ দাদার (ক্ষিতিমোহন সেন) শ্রীপল্লির বাড়ি তখন হয়তো হচ্ছে বা সবে হয়েছে৷ পাশেই অমিতাদির বাড়িতে কিছুদিন থাকতেন তাঁরা তদারকির ইচ্ছায়৷ গুরুপল্লির মৃন্ময় কুটির ছেড়ে নির্মীয়মান পাকাবাড়ি তৈরি যখন শেষ হয়, দাদা-দাদির ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা লাগাবার সময় বাবা উপস্থিত ছিলেন বলে শুনেছি; লাগানো হয়ে গেলে দাদি (কিরণবালা) বাবাকে বললেন, “ছবি, ওনার এই লাঠিটা দিয়ে দূর থেকে পাখার সুইচটা চালিয়ে দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে এস; ঘন্টা খানেক খালি ঘরেই চলুক, যদি ভেঙে পড়ে যায়!”

শুনেছি, বীরেনদার বাড়ির প্রবেশপথ পাতাসমেত স্থানীয় কমলালেবু (পাতি লেবুর মতই আকার তাদের, দেখনহাসি, ভক্ষণের মত জৈব ক্রিয়ার ঊর্ধ্বে) আর অর্ধস্ফূট পদ্ম দিয়ে সাজানো হয়েছিল৷ সে সজ্জায় এবং আলিম্পনে কলাভবনের হাত ছিল শুনেছি — অন্তত যমুনাদির ছিল৷ বিয়ের অনবদ্য পিঁড়িটাও কি তিনি এঁকেছিলেন? খুব সুন্দর, কিন্তু রংটা তেমন পাকা ছিল না; শুনেছি, অন্নপ্রাশনের দিন তাতে বসানো হয়েছিল তখনও টয়লেট-আনট্রেন্ড আমাকে — সেটা গুজবও হতে পারে অবশ্য! তবে রংটা যে ধ্যাবড়া হয়ে গিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। নন্দলাল উপহার দিয়েছিলেন স্বহস্তে জলরঙে আঁকা গৌরবর্ণ আর্য  ও মেঘবরণ শ্যামলী’র ছবি, বাবার আর মায়ের নামানুযায়ী, শুধু সকৌতুকে বাস্তবের গায়ের রং ওলটপালট করে৷ গগনেন্দ্রনাথেরও একটা আন্দাজ ৬”x৯” জলরং, আধা কিউবিস্ট ঢঙে আঁকা ‘পদ্মপত্রে জল’, মায়ের আলমারির বাঁ দিকের ওপরের দেরাজে থাকত; ফ্রেমবদ্ধ হয় নি কখনও। সেটা বিয়ের উপহার না অন্য কোনও ভাবে পাওয়া, জানা হয়নি কোনও দিন। সেই দেরাজেই ছিল তক্ষশীলার থেকে পাওয়া একটা গান্ধারযুগের সুবর্ণ মেডালিয়নের (না কি সেটা স্বাক্ষরপ্রতীম সীল!) ডিম্বাকার প্লাস্টার কাস্ট — ক্ষুদ্রব্যাস এক ইঞ্চি, বৃহদ্ব্যাস ইঞ্চি দেড়েক — বাবার যুদ্ধকালীন সংগ্রহের অন্যতম। মেডালিয়নটা, শুনেছি, এখনও আছে; তবে সেই পদ্মপত্র বহুকাল কেউ দেখেনি, উদ্বায়ী জল উবে গেছে হয়ত। সেই আলমারির অন্যত্র ছিল মেহগনি কাঠের বর্মি ওয়াকিং স্টিক, আসলে কাজিয়া করার লায়েক, দ্বি-ধার গুপ্তি; সেটাও বাবার ওয়র বুটি। হাতল দিয়ে সাতটা নিষিদ্ধ মাপের গুলি ভরা যায় এমন একটা জর্মন মাউজ়ার পিস্তলও আমৃত্যু ছিল বাবার জিম্মায়; সেটা যে কোথায় পেয়েছিলেন জিজ্ঞেস করিনি কখনও। বাবা মারা যাবার পর, আইন মোতাবেক রডা কোম্পানির জিম্মায় ছিল সেটা; পরে মহারাজ মেসো আইনসঙ্গত ভাবেই কিনে নেন৷ আকিয়াব থেকে তুলে আনা কাল-গোত্রহীন বুদ্ধের একটা ছিন্নমস্ত (সেটাও শুনেছি স্থানীয় রীতিবিরুদ্ধভাবে লম্বকর্ণ) ফেলে আসতে হয় বলে সারা জীবন বাবার দুঃখ ছিল, যদিও আমার ঠাকুমার নিজস্ব সংস্কারে গৃহীর ঘরে বুদ্ধমূর্তি রাখা খারাপ। সেই সংস্কারভঙ্গের দায়েই নাকি কয়েক বছর পর তাঁর ভাই, ছট্টি (ডাক্তার এস.কে. সেন)-এর মৃত্যু হয় — দোতলার সিঁড়ি থেকে ঠায় একতলার ল্যান্ডিঙে পড়ে গিয়ে, যেখানে স্থাপিত ছিল একটা অর্বাচীন বুদ্ধমূর্তি। …

… আমার আড়াই বছর বয়স অবধি মা কিংবা আমি বাবার শা’গঞ্জের আস্তানা দেখিনি৷

তারই মধ্যে নাকি আমার ভারত পরিক্রমা শুরু: কখনও লখনৌতে মায়ের মেজমাসির (মমতা দাশগুপ্ত, ডাকনাম লাবু) বাড়ি; কখনও নালন্দার নবোত্থিত ধ্বংসস্তুপের মধ্যে — সেখানে বাবা কিছুটা পর্যটক আর বাকিটা প্রত্নতত্ত্বের নিযুক্ত বেসরকারি আলোকচিত্রী (রোলিকর্ড ২.৬ টি.এল.আর.-এ খুব কম স্পীডের সাদাকালো কোড্যাকে স্বহস্তে তোলা এবং প্রস্ফূটিত; প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রকাশিত ‘মার্গ’ সাময়িকীতে তার কিছু ছাপা হয়েছিল, আর নালন্দাবিষয়ক বাংলা এক ইতিহাস পুস্তকে একটা); কখনও বা দু’পা দূরের পুরী কোনার্ক ভুবনেশ্বর৷ সেই পরিক্রমার দু’একটা হয়ত শা’গঞ্জে থিতু হওয়ার অব্যবহিত পর পর৷ জ্যেঠা বাবাকে বলতেন, “ছবি, তোর পায়ের তলার চাকাগুলো খোল”৷

যতদিন বেঁচেছিলেন, লাবুদি — মায়ের সেই লক্ষ্মণাবতীয় মেজমাসি — আমার এক বছর বয়সের ওজন নিয়ে খোঁটা দিতেন; কোলে তুলতে হয়েছিল তো বেশ কয়েক বার! এখনও তাঁর বড় মেয়ে, ইলিনামাসি, শত ব্যক্তিগত দুঃখের মধ্যেও সে কথা স্মরণ করেন৷ আর লাবুদি সপরিবারে খোঁটা দিতেন আমার প্রাক্–যুক্তাক্ষর শিবরাম পাঠ নিয়ে — সেটা নিশ্চয়ই পরের ঘটনা: শিবরামের লেখা কোনো কেতাবের শিরোনাম নাকি আমি পড়েছিলাম, বি.শ.ব.প.তি  বা.বু.র  অ.শ.ব.ত.র  প্রা.পি.ত — তা সে আমার হাতেখড়ির ঢের আগে!

… কলেজজীবনে মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটে তাঁর মেসঘরে দেখা করতে গিয়েছিলাম এক বার, আমার বন্ধু আশিস (পিটু) সেন আর সেবারের পত্রিকা সম্পাদক সুকোমলের সঙ্গে; যুক্তাক্ষরের গল্পটা সভয়ে বলেছিলাম৷ আশিসের স্বর্গত পিতাঠাকুর ছিলেন এক স্বনামধন্য কবিরাজ; গিরিশ পার্কের কাছে তাঁর ভদ্রাসন ও ডিসপেন্সারির নাম কল্পতরু; শিবরাম তাঁকে বিলক্ষণ চিনতেন! আমায় বললেন, “ওহে অযৌক্তিক  পাঠক, লেখা নেবে তো কল্পতরু-র আশিস  চাও, সুকোমল  করে লিখে দেব!” অসামান্য সেই তাৎক্ষণিক শিব্রামোক্তি স্মরণ ছিলনা এতদিন৷ সেদিন, বালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে আমার লাইব্রেরি থেকে রমণী চাটুজ্জে স্ট্রীট অবধি হাঁটা পথে, বড্ড বেশি বুড়িয়ে যাওয়া আমারই সমনামী এক সহপাঠীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হতে, একথা সেকথায় সে মনে করিয়ে দিল৷ কি করে ভুলে ছিলাম রসশব্দের জাদুকরের সে রসোক্তি!

অযৌক্তিক সেই মলাট-পাঠের ঘটনা শান্তিনিকেতনের বলে আমার সন্দেহ, কারণ সে উপাখ্যানের অনেক শাখাপ্রশাখা, অনেক অশান্তিজনক সাক্ষী৷ যমুনাদি সেবকদা প্রফুল্লদা পর্যন্ত অসমসাময়িক এক জ্যান্ত বেড়ালের লেজের ললালোলি, থুড়ি, নড়ানড়ি  সম্পর্কিত অন্য এক গল্প বলতেন অশ্বতরের সঙ্গে সনিঃশ্বাসে — নিমাইমামা তার সাক্ষী৷ সেই সময়েরই আরেকটা ঘটনা গোঁসাইজিকে (নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী) ঘিরে৷ একদিন যখন সেই বিরলকেশ, শ্বেতশুভ্র গুম্ফশ্মশ্রুময় সদাশয় ব্যক্তিটি মা বাবার সঙ্গে দেখা হতে কুশল বিনিময় করছেন, তে সম্পৃক্ত আমি নাকি গ্রীক নাটকের রীতি অনুযায়ী সোচ্চার জনান্তিকে মাকে শুধিয়েছিলাম, “ইনি উদো, না বুধো?” আমার কি দোষ… হাতে না হয় ট্রেডমার্ক হুঁকোটা ছিল না! যদ্দূর জানি, কথাটা গোঁসাইজির কানে গিয়েছিল — যাবারই কথা; তা সত্ত্বেও পরে আমাকে তাঁর স্বাক্ষরিত ছেলেভুলানো ছড়া  এক কপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সস্নেহে৷

মায়ের ছোটমাসি, অমিতাদিও মৃত্যুর কয়েক বছর আগে, অন্যান্য অপ্রকাশ্য উপাখ্যানের সঙ্গে, এই সব গল্প আমার কনিষ্ঠা কন্যাকে ফলাও করে বলেছেন৷ এতেই বোঝা যাচ্ছে, দিনের আলোর মত স্পষ্ট, মাতৃকুলে আমার প্রসিদ্ধি প্রধানত বিদূষক হিসেবে৷ এই ভূমিকাটা পিতৃদেবেরও পছন্দের; তিনি বলতেন, “রসবোধের সেরা হল সেন্স অভ় হিউমর, ওটা বাদ দিলে মানুষ গোরিলা হয়ে যায়৷”

আত্মজীবনী লেখার চেষ্টায় এ রচনা নয়৷ আটপৌরে সাদামাটা কীর্তিহীনের জীবন নিয়ে আত্মজীবনী চলেনা; পড়বে কে, রচনাই বা লিখবে কারা: “এই যে জোনাকি, ইহাদেরও মৃত্যু আছে; তাইতো কবি বলেছেন…”! কিছু আজব ঘটনা, যার পারম্পর্য এবং স্থানকালের আইনস্টাইনীয় সম্পর্ক আমার কাছে বেজায় বিদঘুটে ঠেকে, মাঝে মাঝে বেজায় মজার, গুনে গুনে পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার জন্য স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেছিলাম আমার ওয়েব লগে — প্রথমে ইংরেজিতে, পরে বাংলায় — ওয়েব বা উর্ণাজালের মত তিল তিল করে বোনা স্মৃতি সব, আপাতবিস্মরণের অতল সমুদ্র থেকে খুঁজে আনা৷

যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে থাকার ইচ্ছে আমার নেই, তবে সেই সরস মুহূর্তগুলোকে কি একটু বাড়তি জীবন দেয়া যায়না!

এই বর্ধিত লেখাটা আমার নিজের সঙ্গে আলাপচারি; বলা উচিত, ফ়্রেমবদ্ধ অল্প একটু সময়ের ক্যামিও স্মৃতিচারণ৷ তবে ডায়রি রাখিনি কখনও, অনেক দরকারি ঘটনা বেমালুম লোপাট; অকিঞ্চিৎকর বহু ঘটনার বিরক্তিকর খুঁটিনাটি কিন্তু ভুলিনি! যেগুলো স্পষ্ট মনে আছে ভাবছি, সেগুলো হয়তো আত্মপ্রতারণা৷ আর মনের ফাইলিং সিস্টেমটাও গোলমেলে — চাইলেই হদিস মেলে না; যখন মেলে তখন তারা সময়ক্রম, ঘটনাক্রম, ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না মোটে, কেমন কাটা কাটা — ধীরগতির ব্রডব্যান্ডে ইউটিউবের ছবির মত৷

তা বলে কি বলব না ছোটমার তৈরি সেই হারিয়ে যাওয়া জিরে চিঁড়ের কথা: চিঁড়ের মত পাতলা আর সরু করে কাটা নারকেল কুচি অল্প আঁচে শুকিয়ে নিয়ে চিনির রসে ফুরফুরে করে আসানো — তাতে রং ধরবেনা একটুও! কিংবা খোকনদা স্বপনদার পিসি, যাঁকে পপ বলতাম আমরা যুগল অকারান্তে, তাঁর রান্না লইট্ঠার শুঁটকি! অথবা জি.টি. রোডের থেকে একটু ভেতরে, আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনের কাছাকাছি কিন্তু উল্টোবাগে, সরস্বতীর শুকনো খাতের অনেকটা তফাতে সেই পানাচ্ছন্ন মজা বাঁওড়, হয়তো সাবেক সরস্বতীরই কোনো কন্যা ধারা, আর বাঘ বাঁওড়  নামের গ্রাম, যেখানে প্যাট্রিক — আমার আঠেরো বছর বয়সে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই ড্রাইভ়িং শিক্ষার গুরু — তার চেনা এক মহিলার কুটিরে নিয়ে গিয়েছিল গাড়ি খারাপ হতে৷ সেরকম সবুজ গ্রাম, ডোবা ভরা শালুক, ডোবার ধারে লুচি পাতা (টাকাপ্রমাণ গোল, ভাজলে লুচির মতই ফোলে, মা পাতলা চালপিটুলিতে চুবিয়ে মাঝেমাঝেই ভাজতেন; বর্ষায় খিচুড়ির পাতে খাসা!) আর টক টক আমরুলি পাতার (কুন্ডু পুকুরের পারেও অনেক হত, আমরা কোঁচর ভরে তুলে সানন্দে চিবোতাম) কার্পেট, গুটি সুদ্ধ পুঁই আর বনকলমির ঝাড়, আমার বুকের হাইটে ঝুলে থাকা কাঁঠাল, রেবেকামাসির ছিটেবেড়ায় লতানে মাকাল পেকে লাল টুকটুক করছে, আর চন্ডীমন্ডপের মত খোড়ো চার্চ — তার মাথায় ফুটিফাটা কাঠের ক্রস — এসব তো আর দেখবে না কেউ সর্বগ্রাসী বাজার অর্থনীতির দৌলতে!

বাংলার কয়েকটা গ্রাম, দু’একটা শহরতলি আর একটা মাত্র মহানগরের কথা, যা অনেক দেখেও আমার আশ মেটে নি এখনও, সেটা অগোছালো হলেও লিখে ফেলতে ক্ষতি কি? একটা ঝাপসা মত ছবি তো ফুটবে! কেউ পড়ুক, না পড়ুক, আজ জোনাকিদের কথা লিখব বলে আমি বদ্ধপরিকর৷

কিছু মানুষের নাম দরকার মত — আবরুর খাতিরে কিংবা অন্য কারণে — পাল্টাতে হয়েছে, উহ্য কিংবা সংকেতে রেখেছি কয়েকটা৷ পেছন থেকে ছোবল মারা সাপ, ঝোপেজঙ্গলে লুকোনো গেল-গেল-সব-গেল হাঁকা ফেউ আর মড়াখেকো নরকের কীটদের ক্ষেত্রেই সেসব বিধিনিষেধ৷ বাকিরা প্রায় সবাই স্বস্থানে স্বমহিমায় আছেন৷ সাহস করে এই অপটু, অগোছালো লেখা পড়বেন যাঁরা তাঁদের জেনে রাখা ভালো, এই স্মৃতিকথা প্রামাণিক তথ্যনির্ভর নয় — এর ওপর ভরসা করে মামলা করলে ধোপে টিঁকবে না৷ এমনকি, যে কবিতার উদ্ধৃতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো যাচাই করবার কোনও উপায় নেই আমার, কারণ বইগুলোর অধিকাংশ আমার সহজ সংগ্রহের মধ্যে নেই৷

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা বয়সে হামের মত কবিতাজ্বর হবেই হবে, তার কোনও প্রতিষেধক নেই; তেমনি আবার কবিতাবয়সে দুঃখবিলাসের আমবাত বেরোয়নি এমন বাঙালি বিরল৷ খুকুমাসি, মায়েদের চার বোনের সবচেয়ে ছোট, নিবিড় শৈশবে, জুতো-মোজা পায়ে থাকা সত্বেও, ডুকরে কেঁদে উঠেছিল একদিন, “কালিপা কন কন কন!” কেন, সে রহস্য ভেদ হয় নি কখনও। তার অল্পদিনের মধ্যেই অসামান্য শ্রুতি ও স্মৃতিশক্তির নিদর্শন রেখেছিল… “তোর দিদিরা কি কি বই পড়ে রে?” “ছাছতো ছোপান, নীতি ছুদা আর হাইটোছ অভ় ইটলিচার!

কৈশোরে কবিতা ভ়াইরাসের প্রকোপে দুঃখের পদ্য লিখতে বসে যেই লিখেছে মাতৃহারা মা যদি না পায়, অমনি পেছন থেকে কঙ্করদা (ক্ষিতিমোহনের ছেলে, ক্ষেমেন্দ্রমোহন, শান্ত-শিবের বাবা) উচ্চৈঃস্বরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মিলিয়ে দিয়েছিলেন পিতৃহারা পা পাবে কোথায়!

মাতৃহারার মা আর পিতৃহারার পায়ের মত হাসি আর কান্নাও যে পাশাপাশি থাকে, রামশর্মা নামধেয় জনৈকের কল্যাণে তা কি জানতে বাকি আছে কারু! আমার জীবনেও হরিষের চেয়ে বিষাদের ভাগ কম নয়, মিলিয়ে মিশিয়ে হরিষে বিষাদ! আমি হরিষের কথা সহাস্যে বলব, বিষাদের কথাও সরসে; দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বক্ষবাদক গোরিলা হওয়ার ইচ্ছে নেই মোটেই৷

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে সুখি আর দুখি জীবনদোলায় দুলছে, তারা যে আসলে একই লোক সে কথা গীতিকার খোলসা করে বলেননি৷ কেনই বা বলবেন; ধ্রুব সত্য কি কেউ দিব্যি গেলে এস্ট্যাবলিশ করে!

###

মোরা নাচি ফুলে ফুলে

ছেলেবেলায় কেউ কেউ আমাকে অকালপক্ব বলতেন৷ হয়তো তাঁদের সাত পুরনো ছেলেভুলোনো রসিকতায় হাসতাম না আমি; হয়তো যাঁরা আমার অপক্ববুদ্ধির খাতিরে আধো আধো বুলিতে কথা বলতেন — যেমন করে কুকুরছানার সঙ্গে কথা বলে কেউ কেউ — তাঁদের দেখলে আমার কচি কপাল ভ্রুকুটিকুটিল হয়ে উঠত; হয়তো আমার নিত্যনতুন শব্দের সঞ্চয়, যা অবশ্যই বয়স্যদের গুলি-টল-লেত্তি-লাটিম, টিনের বরকন্দাজ এবং ডিংকি গাড়ির সংগ্রহের চেয়ে ঢের বেশি সমৃদ্ধ ছিল, বিব্রত করত তাঁদের৷ তা বলে কি সত্যি এঁচোড়ে পাকা ছিলাম!

প্রায় একবছর সাংঘাতিক কামলায় কাবু হয়ে, দীর্ঘ গৃহবন্দিত্বের পর কোম্পানির বাংলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম ১৯৫৫-তে, সে অবশ্য আমার দ্বিতীয় স্কুল যাত্রা৷ নতুন স্কুলে তখন সরকারী ত্রিভাষিক নীতি চালু৷ বাংলা অবশ্যই আমার প্রথম ভাষা, ইংরেজি দ্বিতীয়; তৃতীয় ভাষা হিসেবে বাবা আমার হয়ে বাছলেন সংস্কৃত — সে স্কুলে তার একমাত্র বিকল্প ছিল হিন্দি৷ পরে আবার হিন্দিকেও আবশ্যিক ঘোষণা করে বৎসরান্তে বাতিল করা হল নেহরুর তৎকালীন ভাষাভিত্তিক দ্বিধার দরুন; তবে সে অন্য গল্প, রাজনীতির গল্প৷ তার আগে ১৯৫১-তে চার বছর বয়স পুরতে না পুরতে ভর্তি হয়েছিলাম মিসেস ডি’ক্রুজের এলেবেলে স্কুলে, পড়েছিলাম ১৯৫৩ পর্যন্ত৷

বলছি বটে এলেবেলে, কিন্তু সেখানেই আমার ভাষা শিক্ষার উন্মেষ আর ইতিহাস প্রীতির আরম্ভ; আন্টি ডি’ক্রুজ়ের (ফ্লোরেন্স ডি’ক্রুজ়) এবং, ব্রেন্ডার কচি বয়সে অল্প কিছুদিনের জন্য তাঁর মায়ের, মত পড়ানোর সহজ ঢং আমি আর কখনও দেখিনি। মায়ের আলমারিতে অনেক পুরনো দস্তাবেজের সঙ্গে তোলা ছিল আমার সেই এলেবেলে স্কুলের খাতাপত্র। মায়ের মৃত্যুর পর সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। ইজিপ্টের ভূগোল শিখতে গিয়ে নাইলের বিচিত্র গতিপথ তো বটেই, অধিকন্তু শিখেছিলাম ফ্যারাও সাম্রাজ্যের প্রথম হিয়েটাসের কথা৷

সেই লব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে জুড়েছিল আমার গভীর কামলার সেই বছরটা যা আমাকে গৃহবন্দী রেখে পাঠতৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ঢের বেশি হয়ত। ফলে বাংলা স্কুলে অঙ্ক-অনভিজ্ঞ আমি অনেকটা বাড়তি প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছিলাম; নিজে নিজেই শিখে নিয়েছিলাম সেই প্রজ্ঞার দন্তনখরাদি সযত্নে লুকিয়ে রাখতে। বুদ্ধ-সিদ্ধার্থরও কামলা হয়েছিল; তাঁকে সারিয়ে তুলেছিলেন ভিষকরাজ জীবক। তাইতে আমার ঠাকুমা বলতেন, “আমার এই নাতি স্বয়ং বুদ্ধদেব!” …

তারও অনেক আগে নাকি আমার অক্ষর পরিচয় — বাংলা অক্ষর — যে সব ছড়া বা সহজ গপ্পের বই কণ্ঠস্থ ছিল তার চিহ্ন দেখে দেখে, আর গ্র্যামোফোনের রেকর্ড পরিচিতির দৌলতে৷ এবং সেই সঙ্গে কবিত্বের উন্মেষ, যা আমাকে টা-টা বলে বিদায় নিয়েছে ভালো করে বড় হওয়ার আগেই৷ শুনেছি, তারও আগে, আমি নিজের মনে বলতাম “আবোল তাবোল বইঃ,/ খ্যাপার গানের গইঃ”৷ গুঢ়ার্থের খোঁজ করবেন না, প্লীজ়়, আর বিসর্গ দুটো ফাউ! একদা নাকি, গুরুগম্ভীর, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেছিলাম, “মহাভারতের আঁধার হল গতন গতন,/ খোলো দ্বার রঘু, বঘু বঘু!” ওই বঘু বঘু টুকু বাদ দিলে বাকিটা সহজবোধ্য; আর ছন্দ সৌকর্যে কোনও ছান্দসিক, স্বয়ং প্রবোধ সেনও খুঁত ধরতে পারতেন না৷ তাইতে ঠাকুমা বলতেন, “ক্ষণজন্মা!” বেঁচে থাক আমার পিতৃকুল!

“অস্তি গোদাবরিতীরে বিশাল শাল্মলী তরু…”

এখন বুকে হাত রেখে বলতে পারব না গল্পটা কোন শ্রেণীতে পড়েছিলাম, পঞ্চম না ষষ্ঠ! সেই শিমুল গাছটার শাখায় শাখায় ছিল মেলাই পাখির বাসা৷ আর মনে করতে পারছি না একটা বুদ্ধিমন্ত কাকের গল্প, যে জাপানি বোমারু পাইলটের মত, সাবুরো সাকাইয়ের মত, মিৎসুবিশি জ়িরো বিমানের সাহায্য ব্যতিরেকেই, অভ্রান্ত লক্ষ্যভেদ করত বারংবার (কাকেন পুরীষোৎসর্গং কৃত্বা পলায়মাস), সেটা হিতোপদেশ পাঠ-এর একই কাহিনির অঙ্গ না অন্য উপাখ্যান! স্কুলজীবন শুরু হবার ঢের আগে থেকে সেই বয়ানগুলো শুনে শুনে আমার কণ্ঠস্থ ছিল৷ এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই আমার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়ো এক সম্পর্কে জ্যেঠতুতো দাদা ঝুল পড়া, ন্যাংটো এবং একলা বিজলি বাতির নিচে দুলে দুলে সরল হিতোপদেশ পাঠ মুখস্থ করছে — উচ্চপাঠের সেই হিন্দোল আমার রসানুসন্ধানের পাথেয় হয়ে রয়েছে সেই শিশুর মত, যে নতুন মন্দিরের জন্য তার দোলনটুকু দিয়ে দিয়েছিল (অলোকরঞ্জন, মাপ করবেন)৷ এঁদো বাড়ি, দিনের বেলাতেও অন্ধকার, তবে সেটা পয়োগ্রামের অভ্যস্ত ভদ্রাসনের বদলে পাওয়া ব্যারাকপুরের অযুত আরশুলা অধ্যুষিত প্রাক্-মিউটিনি প্রাসাদ, যেটা পরে গঙ্গাগর্ভে বিলীন, না বৌবাজারের বাড়ির ভেতরেও অন্ধগলির বহুকক্ষের ভুলভুলাইয়ার একটা, তা মনে পড়ে না শত চেষ্টাতেও৷ পয়োগ্রামের সেই সুখের আলয়, অভ্যস্ত আস্তানা, তাদের কয়েক পুরুষের ভিটে, তখন সীমান্ত ছাড়িয়ে এক ভ়িসা পথ দূর —  প্রায় চাঁদের কাছাকাছি৷

চোখ বুজে আমি সেই গোদাবরী নদী দেখতে পেতাম, শিশু চোখে তখনও ভালো-খারাপ-মাঝারি কোনও জ্ঞানাঞ্জনই লাগেনি — তাই অপাপবিদ্ধ দেখা৷ ইন্ডিয়ান অফ়়িসার্স’ কোয়ার্টার (আই.ও.কিউ.)-এর উত্তরে, কারখানা সীমায়, ছিল একটা বড়ো নালা, উৎপাদনের বর্জ্য জল সেই নালাবাহিত হয়ে একটা ঘরে পরিশোধিত হতো, তারপর পড়ত একটা বিশাল পাইপের মুখে; পাইপটা বিষোদ্গারের লজ্জায় সীতার মত পাতালে প্রবেশ করে ফেনায় ফেনায় উদ্ধত, অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত জল উদগার করত ভাগীরথীবক্ষে — দূষণের আইন কানুন তখন আলগা ছিল আরও৷ পাঁচ নম্বরের চিত্তকাকা ফেনা  শুনলেই আমার নাম জড়িয়ে বলতেন “ফাল্গুনে গগনে ফেনে ণত্বমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ” — সেই আমার ব্যাকরণ শিক্ষার শুরু! তবে নিতান্তই পল্লবগ্রাহী সেই শিক্ষা, কারণ দীর্ঘকাল আমার ধারণা ছিল চর্মচটিকা মানে চামড়ার চটি, তৈজসপত্র  মানে তেজপাতা, আর, কেন জানিনা, মনে হত, কেলেঙ্কারি আর ইদানীং শব্দ দুটি ইংরেজি থেকে আমদানি; পক্ষান্তরে, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মোচার ইংরেজি কলিফ্লাওয়ার, কারণ গুরবচ্চন বলত কেলা কা ফুল৷

আই.ও.কিউ. পিতৃদেবের তদানীন্তন হাল সাকিন, অবশ্যই কোম্পানি প্রদত্ত, শা’গঞ্জে তাঁর দ্বিতীয়৷ প্রথমটা, সিনেমাপারের সেই স্টাফ় কোয়ার্টার (১৭২ নম্বর কি?), প্রথমে ছিল বাবা আর খোকাদার যুগ্ম দখলে, পরে খোকাদার একার। যারপরনাই সুন্দরী এবং যুবতী মায়ের সঙ্গে আড়াই বছরের আমি প্রথম সেই বারো নম্বর কোয়ার্টার দেখি, আগেই বলেছি জ্ঞানাঞ্জনহীন চোখে৷ মা আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়ো, আমার নাতিযুবক বাবা মায়ের চেয়ে চোদ্দ বছরের৷  জন্মে  ইস্তক শুনেছি সেটা প্রেমবিবাহ —  আজ  মনে  হয় শুরুতে হয়তো একতরফা

প্রেম ছিল সেটা৷

আই.ও.কিউ. নামটা পোশাকি, বোধহয় চটকল আমলের, কোম্পানির দস্তাবেজে অনেক পরে দেখেছি৷ আমাদের সময়ে লোকে বলত, “ওই যে, নদীর ধারে বারো কোয়ার্টার!” ব্যান্ডেলে ট্রেন থেকে নেমে রিকশাওয়ালাদেরও তাই বলতে হত৷ বাবারটা ছিল বারোটা আজব একতলা বাড়ির শেষের গৃহ: দুটো শয়নাগার, ভাঁড়ার (পেটপুজোর রসদের বদলে সেটা ছিল বাবার আলোকচিত্রীয় অন্ধকূপ) আর রসুই, বসা-খাওয়ার জায়গা, আর একটা জালে মোড়া পিছবারান্দা — শীত কালে দিব্যি তেল মেখে রোদ পোয়ানো যেত উত্তুরে হাওয়া সত্ত্বেও৷ সেখানে রাখা থাকত দস্তার লাইনিং দেয়া কাঁঠাল কাঠের একটা আইস বক্স, সবুজ রং করা। রোজ সকালে ভ়্যান রিকশায় এক চাঙড় বরফ আসত তার শীতলতা বজায় রাখতে। বাক্সের পেছনে একটা সরু নল ছিল গলা জল নির্গমনের জন্য, তাই পিছবারান্দায় স্থান হয়েছিল তার। বাজারে পছন্দ মত মাছের চালান অনিশ্চিত, রাধা সিঙের দোকানে হপ্তায় তিন দিন পাঁঠা কাটা হত — তাও একেকদিন একটু দেরি হয়ে গেলে খতম। তাছাড়া একতলা বাড়িটায় গরমও ছিল খুব; সোলান নাম্বার ওয়ানের খালি বোতলে জল ভরে অথবা ভ়িমটো আর লেমনেড ঠান্ডা করা হত সেই ফ্রিজপূর্ব যুগে।

বাবা বলতেন, “অসুবিধে একটাই, কারণ স্নানঘর ইয়েঘরও একটা; এখানেও তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া!” কলকাতার বাড়িতেও ছিল সবেধন নীলমনি একটি মাত্র বাথরুম, তাও নির্জলা — কলঘর থেকে মগে করে পেতলের গাড়ু ভরে নিয়ে যেতে হত; নয়তো পরমাত্মীয় কোনও যোগানদার মারফত! পরে এস্টেটের যে বাড়িতে বাবার আমৃত্যু ছিলাম আমরা, সেখানেও সেই বিষম তাড়া  বাবার সঙ্গ ছাড়েনি৷ পিছবারান্দার ওপাশে বাঁধানো উঠোন আর ডাকটিকিটের চেয়ে অনেকটাই বড়ো বাগান একটা — কেষ্ট মালির দৌলতে বছরভর সপুষ্পক৷ বাগানের উত্তর সীমায় বর্শা গাঁথা পাচিল, পাচিলের ওপারে একটা তেপান্তরের মাঠ, স্থানীয় জলকলের সম্পত্তি; সেখানে মাঝে মাঝে স্কাউট ও গাইডদের শিক্ষানবিশি কুচকাওয়াজ হত৷

বারোটা একতলা বাড়ি পাশাপাশি তবু ঠিক জ্যামিতিক রেখায় ছিলনা — কোনওটা আগু, কোনওটা পিছু, কোথাও কোথাও অনেকটা ফাঁক৷ স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তবে পাঁচ ও ছয় সংখ্যক বাড়ির মধ্যে ছিল বিস্তর অন্তর — হয়ত একটা গোটা সাড়ে পাঁচ নম্বরের জায়গা হত সেখানে৷ সেখানে সযত্নে অযত্নে বেড়ে উঠেছিল বিস্তর শিউলি, বকুল, হাস্নুহানা, অশোক, নাম না জানা অনেক গাছ, আর একটা একলা কদম, তার ক্ষীরকদম্বের মত ফুল বর্ষার পিচের রাস্তায় হেলাফেলায় ছড়িয়ে থাকত আর ততোধিক হেলাফেলায় পদপিষ্ট হত করুণাহীনতায়৷ পিটুলি গাছটা কেউ পোতেনি, কাকবিষ্ঠায় গজিয়েছিল হয়ত তার অবাঞ্ছিত শুঁয়োপোকার সম্ভার নিয়ে — নিশ্চয়ই সেই চটকলের যুগ থেকে, এত বুড়ো!

প্রতিটি গাছে অসংখ্য পাখির বাসা, তারা এতো বাঙ্ময়, এতো সশব্দ, যে হয়তো তাদের কথা ভেবেই কবি লিখেছিলেন এতোটুকু যন্ত্র হতে এতো শব্দ হয়!  কর্মব্যস্ত ও কলহপরায়ণ বিহঙ্গ-চীৎকার  রবিবার  ভোরেও  থামত না,  আমার  নিদ্রাপিপাসু বাবা-মা পাশ ফিরে দ্বিতীয় ঘুমের সুযোগ পেতেন না ছুটির দিনেও৷ দিনান্তবেলায় তারা পুনর্বার চেঁচাতো, হয়তো বা আসন্ন নিদ্রাসুখের কথা ভেবে, হয়তো স্ব-স্বভাবে৷ সেই পক্ষীকুলের সমবেত পুরীষে সাদা হয়ে থাকত নিচের পিচরাস্তার ওই ইলেকটুকু; বর্ষার অঝোর ধারার দু’মাস বাদ দিলে মনে হতো খড়ি বাঁধানো পথ৷

বড়ো নালাতে গোদাবরিত্ব আরোপ অন্যদের কাছে ঠাট্টার বিষয় ছিল নিশ্চয়, তবে নিতান্ত অমূলক ছিল না; নালার যে দিকে বিস্তর ঝোপঝাড়, সেই দিকে ছিল বনস্পতির মত উঁচু একটা কণ্টকায়িত শিমুল গাছ, বসন্তে লালে লাল হয়ে থাকত; দুঃসময়ে অনেক পাখিকে আশ্রয় দিত, সন্দেহ নেই৷

পূব দিকের ফাটক থেকে একটা কালো পিচের রাস্তা ধা পশ্চিমে গিয়ে শেষ হতো আমাদের বাড়ি একটু পেরিয়ে, তারপর আমাদের ঝোপবেষ্টিত কানামাছি আর রুমাল চোর খেলার মাঠ, ছোট মাঠ, মাঠের উত্তর-পূর্বে দুটো করুগেটেড টিনের গেরাজ — তার একটাও আমাদের নয়, গাড়িই ছিলনা আমাদের৷ ছোট মাঠের উত্তরে বইত বৈতরণীর মত, থুড়ি … গোদাবরীর মত, সেই বড় নালা৷ বড় মাঠটা বৃক্ষে গুল্মের জংলা পাড় নিয়ে বিশাল — ওই কালো রাস্তাটার দক্ষিণ দিগন্ত জুড়ে ছোট মাঠের চৌহদ্দি পর্যন্ত — সেটা বড় ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠ, কাকিমা-মাসিমাদের গুঞ্জনের মাঠ, ক্বচিত কখনো বিয়েশাদি-মুখেভাত হলে প্যান্ডেল বাঁধার মাঠ৷ আর ওই যে টিনের গেরাজ, তার পাশে নির্ভরশীল সাধ্বী সতিনের মত একজোড়া বেনারসি পেয়ারা গাছ সোহাগে স্বপনে বেড়ে উঠেছিল৷ বাবা বলতেন, “বাকি ভারত যাকে আমরুদ (অমৃত) বলে, বাঙালিরা নাসপাতি-পেয়ারের সঙ্গে বাহ্যিক তফাত না করতে পেরে তাকেই বলত পেয়ারা,” তা হবেও বা! সঙ্গে ছিল ডাল-মে-কালা একটা দলছুট জামরুল৷ মোদ্দা কথা, অন্দরমহলের লালিমা সমেত পেয়ারাগুলো মিষ্টি ছিল খুব; ক্ষণজন্মা জামরুলগুলোও, দাড়ি আর কাঠপিঁপড়ে বাদ দিলে, খাসা৷ শর্করালোভী দারুপিপিলিকাদের সঙ্গে লড়াই করে গাছে উঠতাম আমরা — এ ব্যাপারে আমার বয়স্য নন্তু ছিল স্বয়ং শিবের শ্বশুরের মত দক্ষ!

শ্রীযুক্ত আইজ়্যাক মোহিনীমোহন ড্যানিয়েল ছিলেন কোম্পানির দক্ষতম রসায়নবিদ; তাঁর কথা উঠলে আজও, সেদিন থেকে ছয় দশকাধিক পরে, ইয়ং বেঙ্গল যুগের বাঙালি মহাকবির কথা মনে পড়ে, হয়ত বাইবেল ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে ধার করা ব্যক্তিনামের যথেচ্ছ সংমিশ্রনের কল্যাণে৷ তাঁর মেয়ে, হাসি, আমার সঙ্গে পড়ত, ডাক্তার হয়েছিল পরে; ছেলে রিন্টু তখনও জন্মায়নি বোধহয়, জন্মালেও নিতান্ত ইনফ়্যান্ট; ঝন্টু তো কাকিমার মনের মাঝারে ইচ্ছা হয়েই ছিল তখন৷ বিকেল সাড়ে চারটেয় আপিস সারা হলে ড্যানিয়েলকাকা ছাতা মাথায় তাঁর প্রাত্যহিক ব্যায়াম সারতেন সেই পূর্ব-পশ্চিম দুশো গজ রাস্তায় এদিক ওদিক কয়েকবার হনহন করে হেঁটে৷ বিকেলে, কারণ সাড়ে সাত সকালে যাঁকে আপিস যেতে হয়, তাঁর পক্ষে প্রাতঃভ্রমণ দুষ্কর৷ ছাতা মাথায়, নইলে গোদাবরী তীরের যতেক বিহঙ্গ নিরস্ত্র, শিরস্ত্রাণহীন মানুষ দেখলেই চাঁদমারির মহড়া নেবে!

শ্রীযুক্ত গিও’র নামের বানান Guillot ছিল কিনা হলফ করে বলা যাবে না; সেই নাতিদীর্ঘ পৃথুল মানুষটির ছেলে, চেস্টার, আমার এলেবেলে স্কুলের সহপড়ুয়া ছিল৷ পদবির উচ্চারণটা অন্তত সঠিক৷ গিওসাহেবের মা সারা দুপুর তাঁদের ছ নম্বরের সামনের সিঁড়িতে বসে কিছু না কিছু বুনতেন: শীতকালে পশমি জামা, বাকি বছর জুড়ে লেস৷ বরিশাল-মাহিলারার শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন সেনমজুমদার কলেজে আমার পিতৃদেবের সহপাঠী ছিলেন৷ তাঁর আই.ও.কিউ.-এর আস্তানা পাঁচ নম্বরে৷ তাঁর মাতাঠাকুরানি সারা দুপুর তাঁদের সিঁড়িতে বসে ন্যাকড়ায় দেয়া বড়ি, চাটাই-কুলোর আমসত্ত আর আচারের বৈয়াম নিয়ে সতত পলায়মান রোদ্দুরের পেছনে ধাওয়া করতেন৷ (বৈধব্যসূচক কদমছাঁট পাকা মাথা; চিবুকের ওপরেও বড়োসরো আঁচিলের মধ্যে অলক্ষ্যে গজানো একটি সাদা চুল ছিল তাঁর — বিপত্তারিণীর মাদুলির চেয়ে ঢের বেশি এফ়েক্টিভ় ট্যালিসম্যান৷ চিত্তকাকার মেয়ে, পুতুলদি, সৌভাগ্যের চিহ্ন সেই নিঃসঙ্গ দাড়িটি উৎপাটন করে, জ্যামিতি বাক্সে ফুল-বেলপাতার সঙ্গে ভক্তি সহকারে ভরে, পরীক্ষা দিতে যেত৷ পরের বছর হাপইয়ার্লির আগেই আবার গজিয়ে যেত সেই মহার্ঘ্য চিকুর!) সারা দুপুর যে যার নিজের কাজ করতে করতে, সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, স্ব-স্ব মাতৃভাষায়, অনুচ্চস্বরে অনর্গল কথা বলে যেতেন দুজনেই, যেন কত না গোপন শলাপরামর্শ করছেন, অথচ কেউ বুঝতেন না কারু কথা — শুনতেও পেতেন না বোধহয়৷

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলুন, চাই, ইউরেশিয়ান, চারটে ফিরঙ্গ পরিবার ছিল বারো কোয়ার্টারে: ক্যাসটেলারি, ওয়ালিংটন, জোনস এবং গিও৷ আমরা আই.ও.কিউ. ছাড়বার ঢের আগে জোনসসাহেবের দেহান্ত হয়, এবং খোকাদা, সম্পর্কে আমার পিসতুতো দাদা, তাঁর খালি করে দেয়া আট নম্বরে ঢোকে৷ আট নম্বরে থাকতেই বিয়ে হয় খোকাদার, শ্রীপল্লির কালিপদদার মেয়ে কনীনার সঙ্গে (দিদিটা ভালো, আমায় ফলসা খাইয়েছিল); সে বিয়ে আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম, এবং স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছিল “বিয়ে হল, আগুন জ্বালিয়ে যজ্ঞ হল, তবে বিয়ের সাত দিন পরেও পুত্র হল না কেন?” তা নিয়ে এত হাসাহাসির কি!

ন নম্বরে ছিল এক পঞ্জাবি পরিবার; তাঁদের ছেলে বি আমার সমবয়সী, তাও তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল না; হল না, কারণ তার ছিল অদম্য যৌন কৌতুহল; আড়াল পেলেই সে গোপনাঙ্গ পরখ করে দেখতে চাইতো ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে৷

সাত নম্বরে স্বল্পকাল ছিল বেনুগোপাল-বিজয়লক্ষ্মী, তাদের পারিবারিক নাম মনে নেই তবে, অ্যালফ়াবেট ক্লাসে য়্যাফ-য়্যাল-য়্যাম শুনে, তারা যে দক্ষিণী তাতে সন্দেহ ছিল না৷ ওপাড়ায় বাংলা ও হিন্দি একেবারে বলতে বা বুঝতে পারত না একমাত্র তারাই৷

এতদিনের ব্যবধানে নিশ্চয় করে বলা মুশকিল, তবে বারো ঘরের অন্তত দশটায় আমার নিকটবয়সী ছেলেমেয়ে ছিল৷ বারো ঘর মিলিয়ে এক উঠোন না হোক, একই মাঠে খেলতে-খেলতে লড়তে-লড়তে বড় হয়েছি আমরা, বহুভাষিক মিশ্রসংস্কৃতির আবহাওয়ায়; তাই হয়ত বাড়তি সংস্কারের বোঝা থেকে শতহস্ত দূরে থাকা অপেক্ষাকৃত ভাবে সহজ হয়েছে৷

###

সেই জোনাকিরা

সুদূর শৈশবের  স্মৃতিচারণ  হুগলিভাগীরথীর  তীরে  থ়িক্সোট্রপিক  চোরাকাদায়  অসাবধানে হাঁটার সামিল — আমার সুহৃদ সুবীরের মডেল গ্লাইডার একবার খেই হারিয়ে নদীর ধারে পড়াতে গোবিন্দ ঘোষের ছেলের যা হয়েছিল…৷ তখন উদ্ধারকারীকে উদ্ধার করে কে! কোনটা যে নিখাদ স্মৃতি আর কোনটা নকল পাদপ্রদীপে আলোকিত, বোঝা মুশকিল৷ একেকটা স্মৃতি, নিজেই বুঝি, গুরুজনদের কাছে অতিশ্রবণে কচলানো পাতি লেবুর মত; কোনওটা আবার আবছা হয়ে যাওয়া পুরনো ফ়োটোগ্রাফ়ে নকল টিন্ট চড়ানো; অনেকগুলোই ছোটছোট আধ-চেনা টুকরো স্মৃতির কাট-অ্যান্ড-স্প্লাইস সংস্করণ — নির্ভরযোগ্য নয় মোটেই!

আমার জন্মক্ষেত্র ২০২-এর এজমালি ছাদে ভাঙা ট্রাইসাইকেলের চাকাসমেত অক্ষদন্ড নিয়ে কুরুক্ষেত্রে কর্ণের মত বারবেল প্র্যাকটিস মনে পড়ে প্রায় বিনা চেষ্টায়৷ আমার প্রমাতামহের শ্রীপল্লি-শান্তিনিকেতনের বাড়ির কুয়োতলায় তারস্বরে কালিন্দী নদীর কুলে গাইতে গাইতে দুলে দুলে উদোম নাচের কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে — নৃত্যের উন্মাদনায় কে বা কারা আমার দোদুল্যমান নিষ্পাপ প্রত্যঙ্গ সকৌতুকে দেখছে, তারও খেয়াল ছিল না আমার, মনের অন্ধকার কোণে সে খেয়ালের সূচনাই হয় নি তখনও৷ তবে দুটো ঘটনারই খাকি হয়ে যাওয়া কিন্তু প্রামাণিক আলোকচিত্র মায়ের সংগ্রহে আশৈশব দেখে আসছি৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এমন সব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষদর্শী গুরুজনেরা বেঁচে ছিলেন যাঁরা আজীবন সেসব কথা ভুলতে দেননি৷

আমার প্রথম বাস্তব ও স্বতন্ত্র স্মৃতি বোধহয় ওই বারো নম্বরকে ঘিরে৷ তখনও আমি মিসেস ডি’ক্রুজ়ের এলেবেলে স্কুলে ভর্তি হইনি, তখনও চার পুরোতে বেশ কয়েক মাস বাকি, ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছিল সারাদিন — পশ্চাদ্দৃষ্টিতে বুঝি ভরা বর্ষা ছিল তখন, হয়ত বা কবিকথিত মন্থর জুলাই অঙ্কের হিসেবে সেটা ১৯৫০-এর জুলাই হওয়া স্বাভাবিক৷ অবিশ্রান্ত ধারায় আমার মাঠে যাওয়া হয়নি, ডাকতেও আসেনি কেউ৷ বৃষ্টি যখন থামল তখন অস্তরবির প্রহর, স্নাত আকাশে সূর্য নেই, শুধু তার রেশটুকু আছে৷ মা তখন, অগত্যা, পেছনের বাঁধানো আঙনে ক্যাচ বল খেলার অনুমতি দিলেন৷ সে হল গিয়ে একলা ফ্যাকলা নিরুত্তেজ খেলা, মন কাড়া মত্ততা নেই তাতে৷ হয়ত এদিক ওদিক চোখ যাচ্ছিল খেলুড়েদের খোঁজে৷…

তখনই হঠাৎ চোখে পড়ে সেই রত্নমালার নাচ: অযুত-কোটি জোনাকির এক ঝাড়, যেন একটাই উজ্জ্বল নতমুখ ঝুমকো জবা, ভাস্বর এবং থরোথরো বেপথু, একেকবার জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ  আর পরক্ষণেই নিম্নপ্রভ৷ শ্রাবণের বেখেয়ালি হাওয়ায় এদিক ওদিক দুলছিল সেই জোনাকীয় সত্তা; দুলতে দুলতে, কাঁপতে কাঁপতে, ঔজ্জ্বল্যের বিস্তার দেখাতে দেখাতে সে ছোট মাঠের পশ্চিমতম কিনারের ঝোপজঙ্গল ভেদ করে আমাদের পাছ আঙনের দিকে এগিয়ে আসছিল জুলাইয়ের মতই মন্থর গতিতে৷ তারপর বর্শা গাঁথা পাচিল ডিঙিয়ে কালোকোলো লোহার সেপাই অধ্যুষিত জলকলের মাঠে ঢুকে প্যালেস বোর্ডিঙের জংলা কিনারে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেল৷

সে বয়সে সেই গজগামিনীর বর্ণনা করার উপযোগী বোধ বা ভাষা ছিল না আমার, যা লিখলাম তা পরিণত বয়সের স্মৃতিচারণের ফল৷ সেটা যে আদতে ধুস্তরী মায়া বা অবোধ শিশুর রজ্জুতে অজগর ভ্রম নয়, বুকে হাত রেখে আজ আর বলা যাবে না৷ এত বছর ধরে তিল তিল  করে সঞ্চয় করা জ্ঞান, অভিজ্ঞান, শিক্ষা,  দরকচা-মারা সংস্কার ইত্যাকার উপাদানের সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে  হয়ত ছবিটা ফুটে উঠেছে আজ৷ কিন্তু সত্যিই বিশাল ছিল সেই সত্তা, আমার লম্বা গোছের বাবার চেয়েও অন্তত দু হাত উঁচু, নিচের ঘেরটাও হবে ছ ফুট খানেক৷ মনে হচ্ছিল, সব মিলিয়ে সেটা জ্যান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, অনির্বচনীয় গেস্টাল্ট সত্তা যেন একটা, একটা বুদ্ধিমন্ত নেবিউলা যেন যোজন আলোকবর্ষের দূরত্ব থেকে নেমে এসেছে৷…

সেযুগে ফিরঙ্গদের পছন্দের মিষ্টান্ন ছিল ক্যারামেল কাস্টার্ড আর মোল্ডেড জেলি — পলসনের জিল্যাটিন পাউডারে জল-চিনি মিশিয়ে, ছাঁচে ঢেলে তৈরি — দুটোই নাড়া খেলে থরথর করে কাঁপত৷ আমাদের বাড়িতেও সেই সাগরবেলায় বহু টারেটময় বালুদুর্গের মত জেলি মোল্ড ছিল ছ’টা — তার একটা, আমার প্রথম সজ্ঞান পুরী ভ্রমণে, সেই যেবার খুকুমাসি গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে, দুর্গ নির্মাণের জন্য বাবা সযত্নে প্যাক করেছিলেন মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও৷

সত্তাটা অন্তরালোকিত মোল্ডেড জেলির মত থরথর করে কাঁপছিল, শরীরের আলাদা আলাদা জায়গায়, গবাদি পশু যেমন ডাঁশ বসা ত্বকাংশ আলাদা করে কাঁপাতে পারে৷ একই সঙ্গে সে জেলিফিশের মত ত্রিমাত্রায় গতিশীল — সেই উজ্জ্বল জেলিফিশদের ছবি বড় হয়ে কেতাবে দেখেছিলাম, আর তাদের জঙ্গমতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল গহন সমুদ্রের একটা অসামান্য ফরাসি ডকুমেন্টারি দেখে৷ নিজে নিজেই নিজের শরীর তারা টেনে লম্বা করে, পরক্ষণেই হ্রস্ব; সেভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ করে স্বীয় চলন৷

সেদিনের সেই জোনাকীয় গেস্টাল্টটা বড় নালা, তার কিনারে গাবভেরেণ্ডার পাঁচ-ছ টা গাছের জটলা, আকন্দ, ধুঁধুল আর তেলাকুচো লতা, বিছুটি আর নিমঘেঁটুর ঝোপঝাড়, পাতাবাহার আর অযত্নলালিত জংলি গাছগাছড়া পেরিয়ে এগুবার সময়, পাচিল টপকে জলকলের মাঠে ঢোকার সময়, ইয়োইয়োর মত যথেচ্ছ ওপরনিচ করছিল সাবলীল ভঙ্গিতে, পারদের মত কাচ না ভিজিয়েই ত্রিমাত্রায় গড়াচ্ছিল৷ দেখেই বুঝেছি, জান বুঝকে নিজের গন্তব্যের ঠিকানা নিজেই খুঁজে নিচ্ছে! মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে দেখছি কিন্তু দু এক মিনিটের বেশি আমার দৃষ্টিপথে ছিলনা সেটা৷ পাচিল পেরিয়ে, হাঁটু সমান ঢালাই লোহার ফাঁপা ভেন্টিলেটরগুলোর স্থানু কুচকাওয়াজের ওপর দিয়ে, যেন তাদের কুশল প্রশ্ন করতে করতে, এগিয়ে চলল সেই সত্তা৷

ভেন্টিলেটরগুলো জলকলের সম্পত্তি, তাদের আমি লোহার সেপাই বলতাম — সাঁঝবেলায় তেমনই দেখাত তাদের, আবার সারা গায়ে লম্বা লম্বা ছিদ্র, মাথায় ঢালাই হেলমেট৷ আমার মনের চোখে দেখতাম, পনেরোই অগস্ট ময়দানে ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের কাতারের পিছুপিছু লোহার সেপাইদের কুচকাওয়াজ, দাপিয়ে চলেছে পতাকার দিকে মুখ ফিরিয়ে, স্থানু কনুই; ক্লাব হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট নির্মল সেন মাইক হাতে বলছেন, “আজ এই পতোকার নিচে…”৷

আমিও, বক্তৃতা নয়, নিভৃত আলাপচারি করতাম তাদের সঙ্গে, তারা যে আমার জাদু জগতের সখা! তাদের পল কাটা অবয়ব দিয়ে হাওয়া বয়ে যেত — সেদিন সেই বাদলা হাওয়া নিশ্চয়ই জোরেই বইছিল অন্য দিনের চেয়ে — সানাইয়ের পোঁ ধরার মত গম্ভীর আওয়াজে৷ তখনকার অপুষ্পিত বোধশক্তিতেও মনে হয়েছিল আরও একটা বুদ্ধিদীপ্ত জাদুকরি সত্তা আমার নিজস্ব জগতের সঙ্গ চাইছে — লোহার সেপাইগুলোর মত, দক্ষিণারঞ্জনের বুদ্ধুভুতুম লালকমল নীলকমলের  মত৷  হয়ত সে  আমাকে যাচাই করতে এসেছিল সম্ভাব্য সহচর হিসেবে৷

মনে আছে, তার শরীর থেকে একটা আবছা গুঞ্জনের শব্দ আসছিল, এখন মনে হয় সজ্ঞানে মডিউলেট করা আওয়াজ: কম্পাঙ্ক আর আর আলোর মডিউলেশন, যেন সত্যিই কিছু বলছিল কোনও দুরূহ ভাষায় — সুধীন্দ্রনাথ যাকে যবনের নিবিদ  বলেছেন৷ হয়ত আমার সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেই কথা বলছিল সে — এই যেমন এখন আমি কীবোর্ডে নিজের সঙ্গে কথা বলছি৷…

অনেক বছর পর একটা ট্র্যান্সফ়়র্মারের পাশে দাঁড়িয়ে আমি সে গুঞ্জন আবার শুনেছি, তবে যান্ত্রিক, তাতে ভাষাভ্রম হয়নি৷

সত্তাটা দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যাবার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম আমি, ফিরে দেখার লোভে, তারপর একদৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৃশ্যটা রিলে করলাম৷ মা ভালো করে না শুনেই সহাস্যে মাথা নাড়লেন, ঠিক যেভাবে বড়রা অনেক কথা না বুঝে না শুনেই মাথা নাড়ে৷ আমার বাবাকে লোকে বলত বহুজ্ঞানী — তাঁকে পর্যন্ত আমি শোনাতে পারলাম না সেই অবাক করা জোনাকিদের কথা! অথচ, পরে যখন হেপাটাইটিসে হলুদ হয়ে শয্যাশায়ী আমি, এই বাবাই কত লুপ্ত হয়ে যাওয়া অতীত জন্তুদের (যাদের আজকের ছেলেমেয়েরা জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর বলে জানে) কথা বলতেন৷ তাদের কেউ কেউ হাতির চেয়েও কয়েকগুণ বড় কিন্তু তৃণভোজী, কোনওটা বা হরিণের মাপের তবে হিংস্র মাংসাশী৷ বর্তমান যুগেও নাকি আছে সাগরের অগম্য গহনে দানবিক স্কুইড, অর্ণব সর্প (ফ্রিল শার্ক?), লক নেস দানব, আরও কতো সব অবিশ্বাস্য জীব৷ হাওড়া থেকে বাড়ি ফেরার সান্ধ্য ট্রেনে সদ্য কেনা একটা লাইফ় ম্যাগাজ়িনের ছবি দেখিয়ে বাবা বুঝিয়েছিলেন, দূরের নীহারিকা থেকে দলছুট একটা নাতিবৃহৎ গ্রহাণু পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খেলে, অথবা নাকি কান ঘেঁষে গেলেও, কিভাবে এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে দুনিয়া! আমি নাকি তখন আশঙ্কায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম৷ তখন কি অবিশ্বাস করেছি সেসব আজগুবি কথা!

…হয়ত সেদিনটাই ছিল আমার নিষ্পাপ শৈশবের ইতি, চার পুরতে তখনও চার মাস বাকি, কারণ সেদিনই বুঝে নিয়েছিলাম, বড়দের যতটা সহানুভূতিশীল দেখায়, যতটা সর্বজ্ঞ, তার সিংহভাগ মেকি; বিজ্ঞ শিশুদের নিজেরটা নিজেই দেখা ভালো৷

###

ক্রমশ

                           

Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>

 


পদক্ষেপ

Information

5 responses

12 10 2013
prokash

স্মৃতি কথা হিসাবে ভালো লেগেছে। অনেক কিছু জানলাম। পশ্চিম বঙ্গ , কোলকাতার নাগরিক জীবন, কথকের বেড়ে ওঠা, চিন্তা,কল্পনা…। আসলে জীবনে এত ছোট কেনে….

12 10 2013
Aniruddha

ধন্যবাদ!

2 11 2013
bhaskargupta.

atyanta koutuhal niye ei smritikathatuku porlam khub bhalo laglo anek purono smriti moner bhitor resonate k
ore gelo .

5 08 2014
Shanker Dev Mukherjee

Aj theke porte suru korlam, bhalo lagche

5 08 2014
Aniruddha

Thanks for visiting my blog site.

Shanker Dev Mukherjee এর জন্য একটি উত্তর রাখুন জবাব বাতিল