সেই জোনাকিরা (৪–৬) ৷৷ অনিরুদ্ধ সেন

2 05 2013

There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the second.

জগৎ পারাবারের তীরে

কেহ বা কাহারা সেই কোন আদ্যিকালে ছোটদের শিশুনারায়ণ আখ্যা দিয়েছেন পরম ভ্রান্তিতে৷ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শিশু ভোলানাথ  লিখেছিলেন অনুরূপ সংস্কারে৷ মথি লিখিত সুসমাচারেও হোলি ইনোসেন্টদের কথা আছে — বেথলেহেমের সেই সব হোলি  নবজাতক, হেরড যাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল; তারা রক্তের হোলি-তে রাঙ্গা বটে কিন্তু সত্যিই কি আলোচ্য অর্থে ইনোসেন্ট  ছিল?

কে না জানে, শিশুদের মত জাত শয়তান বিরল — স্বয়ং হেরডও যা দুহাজার বছর আগে  জানত! বাংলার ভৌতিক (চন্দ্রবিন্দুর সুবাদে নয়,  প্রাচীনতর অর্থে) ঐতিহ্যে সনাস “বাঁবা,  মাঁ,  পাঁ বেঁতা কঁরছে, কোঁলে নাঁও,” ক-জন বাপমা হাড়ে হাড়ে প্রত্যক্ষ করেননি? যাহা চাই তাহা এক্ষুনি চাই, তর সইবে না, কেঁদে কেটে আকাশ মাথায় করবে! যে সব শিশু এতটা করে না তারা একটু ভেড়ুয়া গোছের, আমি যেমন ছিলাম৷ শিশুনারায়ণ জাতীয় বনিয়াদি ভ্রান্তির উৎস কেউ কখনও যাচাই করে দেখেছেন, নাকি তা নিয়ে গভীর গবেষণা হয়েছে কোথাও?

যাচাই না করাটাই ভারতীয় দস্তুর৷

বাপ, তস্য বাপের শ্রাদ্ধের দিন, পবিত্র নারিকেল রজ্জুতে পাঁচটি শ্বেত-লোহিত মার্জার বেঁধেছিলেন দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচতে (মৎস্যমুখের মাছ কি মাগনা!), যমদুয়ারের দিকে যে পনস বৃক্ষ, তার ডালে৷ ব্যাস, হয়ে গেল! তাঁর সন্তানসন্ততি বিনা জিজ্ঞাসায় বংশপরম্পরায় বাপের শ্রাদ্ধে বেড়াল বাঁধবে, পাট বা শনের দড়ি চলবে না, দরকার হলে ফড়েদের কাছে চড়া দামে স্পেসিফিকেশন মাফিক বেড়াল কিনতে হবে, গুরুপুর নার্সারি থেকে টবস্থ কচি কাঁঠালগাছ ভাড়া করে উত্তরে সংস্থাপন করবেন পুরুত মশাই কিঞ্চিদধিক দক্ষিণার বিনিময়ে৷

সংস্কারগ্রস্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাতিকের মধ্যে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় — মানবিক করুণার অত্যল্প দুধটুকু পর্যন্ত ওই দড়িবাঁধা পাঁচ বেড়ালে খেয়ে যায় — তাকে নাকি হিঁদুয়ানি বলে! কালে কালে তারা অমানুষ প্রমাণিত হলে আমরা কপাল চাপড়াই৷ যে শিশু বেড়ে উঠছে সাংসারিক কুটকাচালি, নর্দমার রাজনীতি, দুর্নীতির আবহাওয়ায়, সে কি ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বাঁচে? ছোটরা ভালো হলে, পড়াশুনোয় খেলাধুলোয় ব্যবহারে ভালো হলে, লোকে নিরন্তর বাহবা বাহবা বললে, বড়রা মানুষ করার ক্রেডিট দাবি করেন; অন্যথায় ডিসক্রেডিটটা কি নারায়ণের?

ভেবে দেখবেন, ছোটদের পছন্দের সাহিত্য কি? কুরুক্ষেত্রে ভ্রাতৃহত্যার মহাকাব্য, পর্ণকুটির থেকে পরস্ত্রীহরণ ও রাম কর্তৃক সীতার অপমানের আখ্যান, সম্পূর্ণ স্বদেশী রাক্ষস খোক্কস, ঠাকুমার ঝুলি এবং ক্লেদাক্ত রক্তাক্ত অন্যান্য সব গল্প৷ (এখন অবশ্য দিনকাল, বিচারের মাপকাঠি, মায় পারিবারিক শিক্ষার রকম-সকম পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে বইগুলোও, হয়ত কমিকসের অধিকতর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এবং অবশ্যই দৃশ্যমান ও শ্রুতিগোচর জঙ্গম মনোরঞ্জনের; কিন্তু শিশুদের রক্তারক্তি রুচিবোধ তিলমাত্র পাল্টায়নি, তা সে মায়েরা যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক!) সে কি নারায়ণত্বের লক্ষণ? ছোটরা যে আসলে তাবড় তাবড় মানুষের বনসাই মিনিয়েচার, বড়দের মতই তীক্ষ্ণ অথবা অল্পবুদ্ধি, বড় হতে না হতে সেটা ভুলে যান বয়ঃজ্যেষ্ঠরা৷ ছোটদের পাপ পুণ্যের বোধ কিংবা ধর্মবোধ না থাকতে পারে, কিন্তু নিজস্ব ঠিক বেঠিকের জ্ঞান টনটনে!

নানা ভাষাভাষী, বিবিধ অঞ্চলের, বারো জাতের পরিবার একত্রে বাস করলে তাদের ছেলেমেয়েরা বহুভাষিক তো হয়ই, বহুখাদকও হয়৷ আমরা বাঙালিদের পাপড়ের মত কড়া আমসত্ত, হরেক রকম বড়ি, উপাদেয় শুঁটকি মাছের বিভিন্ন দফা  রান্না; দক্ষিণী মুড়ুক্কু এবং সাম্বর চাটনি সহযোগে ইডলি (দোসার নাম তখনও শুনিনি); ফিরঙ্গ সমাজের নানাবিধ দ্বিপদ চতুষ্পদ নিষিদ্ধ আমিষ — রোস্ট পাই গ্রিল স্টু কাটলেট ক্রোকে বুলি কর্ন্ড ইত্যাদি বিভিন্ন অবতারে, তৎসহ নানান মজাদার ডেজ়ার্ট; পঞ্জাবি সর্সোঁ দা সাগ এবং দেসি ঘি ভাসানো মা দি দাল; আম কুল গাজর বিট এঁচোড় রসুন লঙ্কা ওল কচুর মিশ্র উৎসের আচার এবং বিস্তর খাদ্যাখাদ্যে অভ্যস্ত  হয়ে  উঠেছিলাম৷ সেই যে ভূমার স্বাদে রসনার শিক্ষানবিশি শুরু হলো,  এখনও তার রেশ চলছে ক্রমায়ত আগ্রাসী হাঁ-হাঁ-কারে৷ নইলে প্রায়োপবাসে সাধের প্রাণটা বেঘোরে যেত; কাজের খাতিরে নিজের এবং পরের দেশে বিস্তর ঘুরতে হয়েছে তো, অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়ার দস্তুর সেখানে, ভাত ডাল চচ্চড়ি পাব কোথায়! উপরি লাভ হলো কুনো বাঙালি হয়ে বাঁচতে হয়নি৷

চার বছর বয়স হতে না হতে আমি গুরু মেনেছিলাম চার নম্বরের বড় কাকিমার ছেলে ননতুকে, কারণ আই.ও.কিউ.তে চারদিকে ধ্রুব আর প্রহ্লাদের মত ক্ষুদে জল্লাদ, বির মত আগ্রাসী শিশুশত্রু বালখিল্য বাহিনী, শত্রুর কি শেষ আছে! ননতু আমাকে দুরাত্মাদের হাত থেকে রক্ষা করার আশ্বাস দিয়েছিল — না চাইতেই৷ নিজেদের বাগান থেকে বর্তুল এবং দৃশ্যত লোভন কুলে লঙ্কা তুলে এনে ভাগ করে খাইয়েছিল৷ “তোর দুটো, আমার দুটো; কুলের মত টক টক আর লঙ্কার মত ঝাল ঝাল হবে নিশ্চয়ই, বাবু বলেছে!” তার পরের ঘটনাটা আই.ও.কিউ.-এর খেলোয়াড়ি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা — জল এবং চিনির সন্ধানে দুজন দুদিকে ধাবমান — স্প্রিন্টের সে রেকর্ড ছেলে বুড়ো ভাঙতে পারেনি কেউ৷

হেদার ক্যাস্টেলারিও ননতুর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল: “নানটুবাবু,নানটুবাবু, বি হমকো মারটা হায়৷” ননতু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললে, “তো হম কেয়া করেগা?” ধাক্কা খেয়ে তখন আমার সর্বজনবিদিত ডাকনাম ফিরঙ্গ জিহ্বায় বিকৃত করে সে নালিশ করত, “বাঙ্গি, বাঙ্গি, ডেকো, ডেকো, নানটুবাবু বাট নহি সুনটা!”  এদিকে আমি শ্যাম রাখি, না কুলে লঙ্কা রাখি!

ক্যারল ওয়ালিংটন সে তুলনায় সাবালিকা, প্রায় হান্টারওয়ালি পর্যায়ের; বলত, “মাদার সেজ়় আই’ম আ উইচ…হোয়েন আই গ্রো আপ আই শ্যাল মেক আ টোড অভ় নানটুবাবু!” তবে এরা কেউ, যাদের নাম করিনি, সেই হাসি ড্যানিয়েল, মৃত্যুঞ্জয় মুখুজ্যে মশাইয়ের যমজ মেয়ে বড়ি-ছুটি, সেনরায় বাড়ির খোকনদা স্বপনদা, তারাও, আমার ব্যক্তিগত বাস্তব এবং গোপনতম স্বপ্নের দুনিয়াটা চিনত না৷…

আমাকে ট্যাঁকে গুঁজে অনেক জায়গায় যেতেন বাবা৷ সুনীতিবাবু, রাজশেখরবাবু এবং পুলিনমামার বাড়ি — যেখানে হয়ত অজান্তেই ভাষাজ্ঞানের উন্মেষ হয়েছিল আমার এবং সাহিত্যপ্রীতির৷ সুনীতিবাবু আমাকে আইরিশ উপকথার দেরদ্রিউয়ের গল্পাংশ শুনিয়েছিলেন; ঠিক শিশুপাঠ্য নয় গল্পটা, তবে মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে বড় হয়ে সে কাহিনি সংগ্রহ করে পড়ে তবে শান্তি! শিল্পী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাবার প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন, একই সিটিঙে বাবা কাঠকয়লায় তাঁর৷ রমেন বাবুর একটা ভিলেজস্কেপের এচিং আমাদের বসবার ঘরে ঝুলত৷ একেকদিন আলোকচিত্রী শম্ভু সাহার সঙ্গে বাবা মেতে যেতেন প্রিনটিঙের ম্যাজিকে৷ ডোভ়র লেনে থাকতেন পরিতোষকাকা, চিত্রকর৷ মাঝে মাঝে রবিবার সকালে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে যেতাম বাবার সঙ্গে, সুষমাপিসিদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে৷ একবার রাসবিহারীর মোড়ের উল্টোরথের মেলায় একটা লাফানে হনুমান কিনে তাঁর বাড়ি গেছি, খয়রি প্যাস্টেলের কয়েকটা আঁচড়ে পুরনো খবরের কাগজের ওপর লাফানে হনুমান সুদ্ধ আমার একটা আদল আঁকলেন; বাবা শুধোলেন, “দুটো হনুমান আঁকলি কেন?” পরে একদিন দেখি আমার সেই প্রতিকৃতির একটা বর্ধিত তৈলরঙিন সংস্করণ এগজ়িবিশনে ঝোলানো৷ আর নিয়ে গিয়েছিলেন এডোয়ার্ড স্টাইচেনের ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফির প্রদর্শনী দ্য ফ়্যামিলি অভ় ম্যান  দেখাতে, তাতে পথের পাঁচালি-র বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত স্নেহস্মিত বুয়ার ছবি ছিল, অপু ও বড়ো দুর্গা সমভিব্যাহারে৷

সেসব দেখে একটা ঝাপসা নান্দনিক বোধ তৈরি হচ্ছিল মনের গভীরে কোথাও৷

বৌবাজারে পয়োগ্রামের পালটি করা বাড়িতে সাবেকিয়ানা আর যৌথ ঐতিহ্যের একটা আলগা মাপের আন্দাজ পেয়েছিলাম৷ ধর্ম জিনিসটার মাপ পেয়েছিলাম গাঁজা পার্কের পাশে ব্রাহ্ম সম্মিলনী সমাজে — হয়তো এগারোই মাঘ, অথবা হয়তো কোনও শ্রাদ্ধবাসরে, স্মরণ নেই — এবং শান্তিনিকেতনে পৌষোৎসবের মন্দিরে প্রায় প্রতি বছর চোখ বুজে নির্জীব বসে থেকে দাদার বক্তৃতা শোনা; একবার গোরাদা(অর্ঘ্য সেন)-দের কীর্তনমুখর বাড়িতে; ভবানীপুরে জনৈক তারাপ্রসন্নবাবুর বৈঠকখানায় তাঁদের শনিবারের সান্ধ্য বৈঠকে চা তেলেভাজা সহযোগে গান শুনে৷ বাবা সেখানে মাঝে মাঝে যেতেন ওই গানের টানে৷ সগুণ নির্গুণ দয়াল ভয়াল হরির গান যে সুদর্শন ভদ্রলোক দরাজ গলায় গাইতেন, গাইতে গাইতে অকাতরে গড়িয়ে পড়ত নয়নধার, পরে শুনেছি তিনি স্ত্রীকে হত্যা করে শ্যালিকাকে বিয়ে করেন৷ আইন তাঁকে ছোঁয়নি, কারণ কর্পাস ডেলিক্টি বলে কি একটা জটিল ব্যাপারের হদিস মেলেনি কখনও৷ সত্যি মিথ্যে জানিনা তবে তাঁর কন্ঠে ভয়াল হরির অপার দয়া ছিল, সন্দেহ নেই৷

ব্যান্ডেল চার্চে মাস্ দেখেছি, গুরদোয়ারায় সৎনাম শুনে হালুয়া প্রসাদ খেয়েছি, ইফ়তার খেয়েছি বহুবার, এমন কি আইভ়্যান কিংবা ডেভ়িড ইজ়েকিয়েলের বার মিৎজ়ভ়ার নিমন্ত্রণ — তাও৷ সেই থেকেই বোধহয় — বাঁশবাগানে ডোম কানা — ধর্মে আর মতি হল না আমার! আমার চর্মচক্ষে ধর্মের যে দিকটা ধরা দিয়েছিল, সেটা হয় চোখ বুজে পিতানোঽসি  শোনা, নয়তো বৌবাজারের বাড়িতে তুমুল কাঁসরঘন্টা আর ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে এত ধোঁয়া যে ভক্তি ছাড়াও আপনি নয়ন মুদে আসে, নতুবা স্ত্রীহন্তারক দুর্বৃত্তের সাশ্রুধার কীর্তন৷

অথবা হয়ত পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একটা গোপন ছন্দ, একটা বৃহত্তর ধর্মের খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলাম, অজান্তে, খেপার পরশপাথর খুঁজে পাওয়ার মত৷

###

তুঁহু মম শ্যাম

শ্যামাচরণ ছিল জাত ঠ্যাঙাড়ে, হুগলির খেঁটে-পাবড়া নিক্ষেপকারী ডাকাতদের (শরৎচন্দ্র স্মর্তব্য) সাক্ষাৎ বংশধর৷ শুনেছিলাম, আসলে সে জিরেট-বলাগড়ের লোক৷ জায়গাটা কোথায় তখন জানতাম না, কিন্তু ওই দোনলা স্থাননামের মধ্যে যে প্যানমুন্ডারি, ফার্সি (ভেবে দেখেছেন, আমরা বাংলায় বলি বেওয়ারিশ বেপরোয়া, হিন্দিভাষীরা বে-র বদলে লা  দিয়ে একই কথা বলে; শব্দগুলো আসলে বহিরাগত, আরবি আর ফার্সির মিশ্রণ) আর আর্য ভাষার মিলিত রহস্য, যেমন শা’গঞ্জ-কেওটা বা ঘুরিষা-ইছাপুর, নিদেন সুতানুটি-কলকেতা, তারই মায়ায় জিরেট-বলাগড় নামটা দাগ কেটে বসে গিয়েছিল৷ কোনও একটা বিশেষ দুষ্কর্ম, হয়ত নরহত্যা করে সে গেরুয়া জটাজুট রুদ্রাক্ষ কমন্ডলু ধারণ করে অকুস্থল থেকে গা ঢাকা দিয়ে বারো কোয়ার্টারে জবরদখল আশ্রয় নিয়েছিল৷ ছদ্মবেশের অঙ্গ হিসেবে সে নাকি বেজায় দুর্বোধ্য হিন্দিতে কথাবার্তা বলছিল৷ কাজের লোকেরা আর বউ ঝিরা তো ভয়ে কাঁটা! বাবার কানে যেতে ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের অপেক্ষাকৃত কম ধর্মভীরু কয়েকজন শ্যামা খুনেকে ধরতে এলো৷ সেয়ানা শ্যামা বেগতিক দেখে, পরনের শেষ সুতোটা পর্যন্ত খুলে রেখে, সটান বেলগাছে, পরে যেখানে ব্যাচেলরস’ হস্টেল হয়েছিল, তার পাশে৷ সেই উচ্চাসন থেকে সে তার নিজস্ব হিন্দিতে অবিরাম গালি নিক্ষেপ করে গেল, সঙ্গে ধুপধাপ পাকা বেল৷ শেষমেশ দমকলের লোকেরা এসে জলের তোড়ে নামালো শালাকে!

মনে থাকার কথা নয়, তবু মনে আছে, কারণ হয়ত নিস্তরঙ্গ জীবনে বিশেষ কিছু ঘটত না৷

তাই বোধহয় মনে আছে ভাটির টানে কলার ভেলায় ভেসে আসা ডুরে শাড়ি পরা সেই কিশোরীটিকে, সাপে কাটা মেয়ে, যাকে তার প্রিয়জনেরা কে জানে কোথা থেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল হুগলির জলে, যদি তার ভাগ্যে কোনও ঘুমভাঙানিয়া গুনিন থাকে ভাঁটির পথে৷ আরও মনে আছে বেনুগোপাল বিজয়লক্ষ্মীদের বিধবা আয়া গঙ্গার কথা, যে দুধওয়ালা গোবিন্দের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কাঁচরাপাড়ায় ঘর বাঁধে৷ জি.টি.রোডের ওপারে ফরাদ (ফ়িরহদ্?) আলি সাহেবের বাগানে দলছুট একটা বাঘ ধরা পড়েছিল একদা৷ প্রমাণাভাবে সার্কাস পালানো বাঘ বলা চলেনা৷ কোত্থেকে শা’গঞ্জে উপস্থিত হলো কেউ বলতে পারেনি৷ মেছো বা গুলে বাঘ নয়, খাস রাজকীয় বাঙালি! তাকে কোনওক্রমে খাঁচায় ভরে দুদিন রাখা হয়েছিল আলি সাহেবের বাগান বাড়ির হাতায়, এক আনা করে টিকিট; গঞ্জ-বেগঞ্জের অন্যান্য গাঁইয়া মানুষের মত চিত্তদার সঙ্গে ননতু আর আমি দেখতে গিয়েছিলাম৷ পরে বাঘটাকে চিড়িয়াখানায় দেয়া হয়৷ ফরাদ আলির বাগান হেজে যাবার অনেক পরেও বিলায়েৎ আলির পুকুরসহ বাগানটা টিঁকে ছিল। সেটাও জি.টি. রোডের ওপর তবে কাটোয়া রেলগেট ছাড়িয়ে কিছুটা উজিয়ে। সেখানে রোমাঞ্চকর তেমন কিছু ঘটেনি, তবে লুকিয়ে সিগারেট খাবার পক্ষে খাসা ছিল জায়গাটা!

আরেকটা ধুম্রাক্ত জায়গা ছিল কাটোয়া রেলগেটের বাঁ দিকে যে রেল কোম্পানির কালভ়ার্ট, সেটা। ধুম্রায়ণের অনেক আগে থেকেই সেখানে আমার যাওয়া আসা; কানাই শিখিয়েছিল, লাইনের ওপর একটা তামার পয়সা রেখে ঘাপটি মেরে কালভ়ার্টে বসে থাকতে। একটা দুটো চাকা তার ওপর দিয়ে গেলেই ছিটকে পড়ে যেত বিকৃতাবয়ব পয়সাটা, ট্রেন চলে গেলে একটু কষ্ট করে খুঁজতে হত পয়সাটা — ঘর্ষণে তার লালিমা ও চাকচিক্য ফিরে যেত, আকারটা শুধু অপটু হাতে বেলা রুটির মত লম্বাটে আর পাতলা।…

আমার পুরাতনতম স্মৃতিগুলো, যাদের স্বচ্ছন্দে স্বোপার্জিত স্মৃতি বলে দাবি করতে পারি, সবই বারো কোয়ার্টার কেন্দ্রিক৷ আমাদের বারো নম্বর বাড়ির ঠিক সামনের রাস্তা পেরিয়ে কয়েকটা বাহারে পাতাবাহার ছিল৷ এক উজ্জ্বল সাতসকালে তার একটার মধ্যে, দৃশ্যমান পাতার আড়ালে, সযত্নে গড়া একটি পাখির বাসা আবিস্কার করেছিলাম স্বচেষ্টায়; আমার দেখা প্রথম পাখির বাসা৷ কেউ বলে দেয় নি সেটা কি, তবু আমার চিনতে ভুল হয়নি এক চুল৷ তার মধ্যে ছিল খয়রি ছোপ ধরা তিনটে ছোট ছোট ফিকে নীল ডিম, আমার প্লাস্টিকের হাট্টিমাটিমটিমের অনবরত পাড়া ডিমের মত বর্তুল নয়, অতোটা ছোটও নয় হয়ত৷ জিজ্ঞাসু চৈতন্য আমাকে বার বার ডেকে নিয়ে যেত সেই বাসার কাছে, তবে কাউকে কখনও বলিনি তার কথা, সে আমার নিজের আবিস্কার, একান্ত আমার৷ শুধু প্রথম স্মৃতি নয়, আমার প্রথম অধিকার বোধও সেটা, সেই জোনাকিদেরও আগে৷ চোখের সামনে সেই পক্ষীযুগল পালা করে তা দিল, একদিন ডিম ফুটে বিষ্ঠা মাখা নোংরা চেহারার রোমসর্বস্ব হলুদবরণ বাচ্চাগুলো বেরিয়ে এলো, বিশ্বরূপ দেখানোর মত অসম্ভব মুখব্যাদান করে থাকত তারা, অহরহ বাপমায়ের মুখনিঃসৃত আহার্যের খোঁজে৷ চোখের সামনে তাদের বেড়ে উঠতে দেখলাম (কই, আমি তো তেমন হই হই করে বাড়িনি!), তাদের শিক্ষানবিশি উড়ান প্রচেষ্টা দেখলাম, তার পর একদিন দেখলাম শূন্য বাসা, পাখি উড়ে গেছে স্বনির্ভর হতে না হতেই৷ সেই শূন্য নীড় আমার মনের গহনে রমেন চক্রবর্তীর  এচিঙের  মত  দাগ  কেটে  বসে গেল বিষাদের প্রতীক হয়ে৷ গভীরতম বোধে সেটা মৃত্যুরও প্রতীক, কারণ সেই পরিত্যক্ত গাছের নিচে সবচেয়ে কমজোরি ছানাটার শব দেখেছিলাম… তার বাপমা ভাইবোনেরা ফিরেও তাকায় নি, সেটা দস্তুর নয় বলে৷

ওই বারো কোয়ার্টারেই প্রথম মানুষেরও মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলাম৷…

কিছুর মধ্যে কিছু নেই, একদিন হঠাৎ কলকাতা থেকে একটা কাচে মোড়া শববাহী গাড়ি এলো মিস্টার জোনসকে নিয়ে যেতে৷ আরক্তচক্ষু, ক্রন্দনরতা মিসেস জোনসের চেহারাটা হুবহু মনে আছে আমার৷ তিনি ড্রাইভার চালিত একটা কালো গাড়িতে পেছন পেছন গেলেন, সঙ্গে মিসেস ক্যাসটেলারি ও ওয়ালিংটন৷ আরো দুএকটা গাড়ি সঙ্গে গিয়েছিল, মনে আছে৷ তবে সেই পাখির বাসাটার মত আট নম্বর খালি পড়ে রইলো না, অপেক্ষায় অপেক্ষায় অবহেলিত, ঝোড়ো হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হল না৷

তার অল্প দিনের মধ্যে, যাদবপুরে তাঁর নবনির্মিত বাড়িতে গৃহপ্রবেশের কিছু কাল পর, আমার দাদামশাইয়ের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হল, এখন বলে সেরিব্রাল স্ট্রোক৷…

তাঁর গৃহপ্রবেশের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেন কালকের কথা৷ আমরা সকলে গৃহপ্রদক্ষিণ করছিলাম পূজাপাঠের শেষে; খুব মজা পেয়েছিলাম — যে কোনও শিশুর মত — সেই সাড়ম্বর প্রদক্ষিণে৷ আমার পছন্দ ছিল পানাপুকুরের দিকটা, যেখানে কংক্রিটের সেপটিক ট্যাঙ্কের বেসামাল ঢাকনাটা একদিকে পা দিলেই ঢেঁকির মত ঢক ঢক করছিল৷ বাপের শরীর খারাপের খবর পেয়ে মা তক্ষুনি আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন৷ সেই যে পড়লেন দাদু, আর চোখ খোলেননি একবারও৷ পরের দিন ভোরে শুনলাম দাদু স্বর্গে গেছেন৷ সেই ধূসর সকালে দাদুর ঘরেরই বাগানমুখি একটা জানলার হাতায় গরাদ ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলাম আমি, বুকের ভেতর একটা ফাঁকা ভাব, যেন কিছু একটা নেই, আর ফিরে পাব না কখনো৷…

দাদামশায়ের কথা বলতে গেলে দিদিমার কথা উঠবেই — দিদিমা মানে ক্ষিতিমোহনের জ্যেষ্ঠা কন্যা, রেণুকা। তিনি আমাকে বাবুসোনা বলে ডাকতেন, তাই আমিও উল্টে তাঁকে বাবু  বলতাম। আমার গপ্পের ঝুড়ির বেশ কিছু গপ্পো বাবুর কাছে শোনা। ঢাকার চেয়ে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর গভীরতর আলাপ ছিল; অল্প বয়সেই বিয়ে হলো ‘আইতে সাল যাইতে সাল’ বরিশালে। শ্বশুরবাড়ি যেতে না যেতেই তাঁর জ্বর হয়েছে, যত্ন আত্তি করছে সে বাড়ির নতুন আত্মীয়েরা। শ্বশুর কূলের কোনও গুরুজনস্থানীয় পুরুষ রেণুকার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ও মনি, এখন একটু ভালোবাস নি?” সেই কচি মেয়েটা কি করে জানবে যে বরিশালের বাগ্ধারায় ‘মনি’ মানে সম্বোধনসূচক dear, আর ‘বাস নি’ মানে ‘আছ কি !’ সুনীতিবাবু কি বলেছেন কোথাও, তামাম ভারত যাকে প্রেম বা প্রীত বলে, তাকে আমরা ভালবাসা বলি কেন? নরেন্দ্র দেব মশাই তাঁর স্বগৃহের নাম কি অর্থে স্থির করেছিলেন, good house অর্থে, না কি ভালো থাকা অর্থে?

মায়ের ভাষায়, দাদু আমায় আদর দিয়ে দিয়ে মাথাটি খেতেন৷ শেষ যে জন্মদিনের উপহার তিনি সহাস্যে তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে, বাদামি চামড়ার পাড় লাগানো একটা জলপাই রঙের ক্যানভাস স্কুল ব্যাগ, তার মধ্যে এক বাক্স ভ়ীনস্ পেন্সিল, কাঠের ফুট রুল, বড়োসরো ইরেজ়র, রানা প্রতাপ মার্কা ড্রইং খাতা, রীভ়স ক্রেয়নের লম্বা বাক্স আর বেশ কয়েকটা বই৷ তার একটা, ডরোথ়ি জনস্টনের নো-গুড, দ্য ডান্সিং ডংকি , কৈশোরতক আমার পরম প্রিয়, খাটের পাশে সযত্নে রাখা থাকত যখন ইচ্ছে পড়ার জন্য৷ আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট ভাই সেটার দফা সারে যখন, সে তখন গল্প শোনার পোকা৷ ভাইকে দোষ দিয়ে কি লাভ; খোকাদা একবার বিলেত থেকে আমার জন্য এনেছিল একটা দম দেয়া নাচুনে গাধা, অবিকল নো-গুডের মত; তার ভেতরে কি আছে দেখতে গিয়ে আমি তার দফা রফা সেরেছিলাম কয়েক হপ্তার মধ্যে!

খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে জোড়া-হাঁটু শুন্যে তুলে রাখতাম, ভাই আমার পেটে পা রেখে হাঁটুর উচ্চাসনে বসত৷ আমার হাতে তখন বুড়ো আংলা  কিংবা কালোর বই  শ্যামবাজারি ঢঙে

স্–স্–স্–সনিবার তায় বৈসাখে

(তুই) ম্রেছিস আমার সেজদাকে;

সারা সিত্কাল উপুসি ভাই,

সালিক বাসায় সেঁধুলো তাই…

অবধি পড়লেই পা দিয়ে পেটে ঢুঁ মেরে বলত, “আবাল, আবাল”; তৎক্ষণাৎ আমি বলতাম, “ঢুঁ খেয়ে তো পেট ভরে না, সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে!” কিন্তু সেই নাচুনে গাধার গল্পটা বোধহয় কখনো বলিনি তাকে৷

দাদুর মৃত্যুর কিছু পরেই আমি বাড়াবাড়ি রকমের জন্ডিসে পড়ি, সাত মাস শয্যাশায়ী, বাকি বছরটা গৃহবন্দি৷ আমার মনের গহনে সেই জোনাকিরা, নষ্ট নীড়ের নিচে পড়ে থাকা সেই উড়তে না শেখা পাখির ছানা, জোনস সাহেবের অন্তিমযাত্রা, বামনদাদুর মৃত্যুপ্রশান্ত অবয়ব, আমার অসুখ ও দিনের পর দিন সেদ্ধ মেদ্ধ খেয়ে বিছানায়, এবং চিরকালের মত বারো কোয়ার্টার ছেড়ে যাওয়া অঙ্গাঙ্গী হয়ে রয়েছে৷ সে সব স্মৃতি তালগোল পাকিয়ে মনের ভেতর একটা কষ্টের প্রতীক হয়ে বেঁচে রইলো, ঢোঁক গিলতে গলা ব্যথা করা কষ্ট৷ বহু বছর পর, সম্ভবত সাতের দশকের গোড়ায়, সেই এক ঝাঁক বুক খালি করা বঞ্চনার প্রতীকের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল আরেকটা: ত্রিবেনী শ্মশান ঘাটে যে দেয়ালহীন ইটের গোলাকৃতি ছাউনি আছে, তার একটা থামে শ্মশানেরই কাঠকয়লা দিয়ে লেখা ছিল, নিদয় হরি, কি নিলে!

###

অরুণোদয়

সে যুগে টি.ভি. না থাকায় এবং বেসামাল কামলার কল্যাণে দারুন লাভ হয়েছিল, বিস্তর পাঠ্য অপাঠ্য বই পড়েছি, উভয় ভাষায়, ছোটদের এবং বড়দের৷ সব যে বুঝেছি তা নয়: শ্রীকান্ত  প্রথম পর্ব আর দেওঘরের স্মৃতি  বাদ দিলে শরৎচন্দ্রকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে, বুঝিনি কখনও, এখনও বুঝিনা৷ তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোকের বাংলা গদ্যটা ঝকঝকে বইকি! অধিকাংশ চলিতভাষার বইয়ের সঙ্গে সাধুভাষায় দক্ষিণারঞ্জনের অনন্যসাধারণ রূপকথা, কথাসরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি  কিংবা রবিন হুড-এর অনুবাদ পাঠে বিঘ্ন ঘটেনি কখনো; রসগ্রহণে আগ্রহ থাকলে গোলমাল হওয়ার কথা নয়৷ শেষ তিনটে বইই, সম্ভবত, কুলদারঞ্জন রায়ের অনুবাদ, দিয়েছিলেন জনৈক প্রকাশক, পুরীতে একদা তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বাবার৷ আমার সাহিত্যরসিক ঠাকুমা দেখ না দেখ যে কোনও উপলক্ষ কল্পনা করে নিয়ে বই উপহার দিতেন৷ দাদাকে দিয়েছিলেন দু সের ওজনের বিশ্বপরিচয়; সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে দাদার পায়ের বুড়োআঙুল ছেঁচে গিয়েছিল৷ অমনি আমি পক্ষপাতের অভিযোগ আনলাম, আমাকেও পা কাটা বই দিতে হবে! একটা তিন-সেরি কৃত্তিবাসী রামায়ণ পেয়েছিলাম সেযাত্রা (আদরের ফাল্গুনিকে অন্য একটা পা কাটা বই: নানা), সেটা একবার কাকে ধার দিয়ে আর ফেরত পাইনি৷ তিনি যদি এখনও বহাল তবিয়তে থাকেন, এবং তাঁর চোখে যদি দৈবাৎ এই লেখাটা পড়ে, দয়া করে ফেরত দেবেন, প্লীজ়!

কলকাতার বাড়ির খুব কাছাকাছি বেশ কয়েকটা বড়োসড়ো বইয়ের দোকান ছিল তখন৷ আমাদের ফুটপাথেই ছিল আইডিয়াল বুক স্টল আর, খুব অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও, টবকো বলে একটা তামাক এবং বইয়ের যৌথ দোকান — বাবা সেখানে গোল টিনের তিন সন্ন্যাসিনী  তামাক কিনতেন, অথবা কাঠের বাক্সে হাফ়-আ-করোনা  সিগার এবং অবশ্যই কাগজ মলাটের রগরগে খুনখারাপির বই, মিকি স্পিলেন কিংবা এলারি কুইন৷ টবকো থেকে ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চরঙ্গ  কিনেছিলাম; কিশোরপাঠ্য পাঁচটি সাবেক গল্পের সরস সংকলন, সম্ভবত অজিত গুপ্তের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ আজও মনে আছে৷ আমার জন্ডিসের সময় কেউ টবকো থেকে কিনে এনেছিল সচিত্র বিমল দত্তের সিং খুড়োর গল্প, তার মলাট ছেঁড়া কপিটা এখনও আমার সংগ্রহে আছে৷ আদতে মৌচাকে প্রকাশিত সে গল্পসংগ্রহ আর ছাপা হয়নি কখনও; তাতেই বোঝা যায় বাঙালির পাঠরুচি কোন পথে! আইডিয়াল থেকেই সেযুগে আমার বেশির ভাগ বই কেনা; হেমেন ঘোষের বকুল পরি আর রামধনু, বিভুতিভুষণের হীরামানিক জ্বলে, সীতা দেবী শান্তা দেবীর নিরেট গুরুর কাহিনী  আর হিন্দুস্থানী উপকথা, সুনির্মল বসুর হুলুস্থুল  (কুকুরের তাড়া খেয়ে শেঠজি ছুটতে ছুটতে বলছেন, “প্রবাদ জানে হামি তুমি,/ কুত্তা তো আর তা জানেনা!”), বঙ্গানুবাদে ধনগোপালের চিত্রগ্রীব  আর যুথপতি৷

স্মরণীয়তম হল একই দিনে আইডিয়াল থেকে কেনা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের দুটি কবিতার বই: লাইল্যাক মলাটের কুহু কেকা  আর চাঁপা রঙের বেনু বীণা৷  আজকের সমালোচকেরা সত্যেন দত্তের নাম শুনেই নাসিকা কুঞ্চন করেন৷ আমি মন্দাক্রান্তা (পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল, কই গো কই মেঘ উদয় হও,/ সন্ধ্যার তন্দ্রার মুরতি ধরি মেঘ মন্দ্র মন্থর বচন কও) শিখেছিলাম তাঁর কবিতা পড়ে; বড় হয়ে মেঘদূত (কশ্চিৎ কান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ, কিংবা, আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্) স্ক্যান করতে একটুও অসুবিধে হয়নি৷ বয়ঃসন্ধির ঢের আগে চার্বাক ও মঞ্জুভাষার কিশোর প্রেমের (বনপথে চলেছে চার্বাক,/ সূর্যতাপে স্পন্দিত সে বন,/ ক্লান্ত আঁখি, বিষন্ন, নির্বাক,/ বিনা কাজে ফিরিছে ভুবন) কবিতা পড়ে দস্তুরমত উপভোগ করেছি৷ আর “সব চেয়ে যে শেষে এসেছিল,/ সেই গিয়েছে সবার আগে চলে,” অপত্যশোকের সেই অসামান্য কবিতা কি সত্যিই দ্বিতীয় শ্রেণীর? পেটে পা রেখে আমার হাঁটুতে বসে ভাই …

টেঁপা টোপাটি,  তুমি দোপাটি,

তোফা খোঁপাটি, বাঃ,

বাঁকানো শুঁটি  বিনুনি দুটি

না হয় ঝুঁটি হাঃ!

অথবা, পিয়ানোর গান …

তুল তুল টুক টুক,

টুক টুক তুল তুল,

কোন ফুল তার তুল,

তার তুল কোন ফুল…

শুনে খুব মজা পেত৷ সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছিল আমার ছন্দের কান৷

কলকাতার বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাথে তেরচা ভাবে ত্রিকোণ পার্কের কাছাকাছি ছিল জিজ্ঞাসা; সেখান থেকে সুনীল সরকারের কালোর বই (কিন্তু ছড়া গুলো মামার) কিনেছিলাম, আর  গিরীন্দ্রশেখর  বসুর  অনবদ্য  লালকালো৷   কলেজ  ছাড়ার  পরে গিরীন্দ্রের ধূসর কাগজ মলাটের স্বপ্ন  কিনেছিলাম লালকালোর চেয়ে একটু কম আগ্রহে; তা থেকে মনের ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর’ একটু আভাস পাওয়া গেল — আমার নয়, অন্যদের; আমারটা খামোখা উৎসারণ করতে যাব কেন? সুনীতিবাবুর ওরিজিন অ্যান্ড ডেভ়েলপমেন্ট অভ়় দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ  অনেক পরে সেই পতনোন্মুখ জিজ্ঞাসাতেই কেনা৷

আমার জন্মের আগেই সিগনেট প্রেস তৈরি হয়েছে; শুনেছি, টুনটুনির বই-এর সিগনেট সংস্করণ ছাপা হয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে সংগৃহীত বাবা-জ্যেঠা-পিসির ছেলেবেলাকার আদি সংস্করণ অবলম্বনে, কারণ অন্য কপি চটজলদি খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ উপেন্দ্রকিশোরের স্বহস্তে আঁকা ছবি সম্বলিত খয়রি হাফটোন মলাটের পুরনো কপিটাও আমাদের কাছে ফেরত আসে৷ লীলা মজুমদারের বেশ কয়েকটা বই সিগনেটের ছাপা: হলদে কালো চৌখুপি মলাটে দিনে দুপুরে  (কেরোসিনের সুবাতাসে/ মহাপ্রাণী খইস্যা আসে,/ খাও খাও ভইরা টিন,/ কেরোসিন কেরোসিন) আর, তার বহু পরে, তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জনের হিংস্র চোখে তাকিয়ে থাকা বাঘ মলাটের বনের খবর বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য৷ গগনেন্দ্রের ভোঁদড় বাহাদুর, অবনীন্দ্রের বুড়ো আংলা  আর সবুজ মলাটে চিনে কালিতে আঁকা, শঙ্করের ছবি সুদ্ধু, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড়  কি ভুলতে পারে কেউ! অধিকাংশ মলাটই সত্যজিতের আঁকা, যাঁকে ছেলেবেলায় মা এবং তাঁর শান্তিনিকেতনের বন্ধুকুল আবোল তাবোলের ছেলে  বলে চিনতেন৷ এখন কেন বাংলা শিশু সাহিত্যে সেই অসামান্য নক্ষত্রপুঞ্জ চোখে পড়ে না; চোখের দোষ, না বয়সের?

আইডিয়াল বুক স্টল এখনও যথা স্থানে আছে, এবং তার অন্য পাশে বি. বড়াল অ্যান্ড সন্সের মনিহারি দোকান, যদিও চেনা মুখগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই আর দেখি না৷ দোকানই থাকে না, মানুষ কোন ছাড়!

ঠাকুদ্দা-ঠাকুমা থাকতে আমরা কলকাতায় এলেই সকালে লুচি (বিশুদ্ধ গব্য ঘৃতে ভাজা) খেতাম: সঙ্গে হয় ছোটছোট চৌকো করে কাটা আলুভাজা, সহভর্জিত শুকনো লঙ্কার অনুপান দিয়ে; নয়তো কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে চৌকো কাটা আলুর বাটিচচ্চড়ি, হরিদ্রাবর্জিত, নামানোর আগে একটু কাঁচা সর্ষের তেল৷ শেষোক্তটার ঘরোয়া ডাক নাম ননি তরকারি, কারণ ঠাকুমার ডাক নাম ছিল ননি৷ সোনার মত ঝকঝকে কাঁসার থালায় গরম গরম স্তুপাকার লুচির সঙ্গে কাঁসার বাটি ভরা ননি তরকারি, দারুণ, তার সঙ্গে এট্টুস চিনি দিয়ে নিলে জমে কুলফি!

সুধী পাঠক হয়তো ভাবছেন, বেশ বই পত্তরের কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে খাবার দাবার এলো কোন লজিকে? আহা, পেটে খেলে তবেই তো পাঠ সইবে; একটু স্বাদ বদল করতে দোষ কি — তা ছাড়া কবিও বলেছেন, “জেনো সে রসের সেরা বাসা রসনায়!”

###

Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>





সেই জোনাকিরা (১–৩) ৷৷ অনিরুদ্ধ সেন

18 09 2012

There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the first.

হরিষে বিষাদে

না, খুলনার ভৈরব নদের কিনারে পয়োগ্রাম নামের যে অকিঞ্চিৎকর গ্রামে আমাদের পারিবারিক ভিটে, যেখানে পশ্চিমবাড়ির ঈশান কোনের ভাঙা দেউলের পেছনে ঝুরিসর্বস্ব অশ্বত্থের নিচে আমার তামাম পূর্বপুরুষের নাড়ি পোতা, সেখানে জন্মাইনি আমি৷ আজীবনের বৃন্দাবন শা’গঞ্জেও না৷ জন্মসুত্রে মহানাগরিক, খাস কলকাতায় জন্ম আমার৷ নাগরিকের অন্য এক অর্থ বিদগ্ধ বা রসিক — আদি ও অকৃত্রিম অমর কোষ, অভাবে হরিচরণের বঙ্গীয় শব্দকোষ দেখে নেবেন! আমরণ সেই বিস্মৃত অর্থের মহানাগরিক থাকতে চাই পাঁচ জনের শুভেচ্ছায়৷

তখন যুদ্ধ শেষ৷ বাবা (আর্যকুমার ) চেয়েছিলেন কোহাটের (অধুনা পাকিস্তানে) জয়েন্ট সর্ভ়িসেস হাসপাতালে আমার শুভাগমন হোক৷ তিনি তখন সেখানে বিমান বাহিনীতে কর্মরত; সদ্য রাজকীয়তা ঘুচে বাহিনী তখন শুধুই ভারতীয়৷ তাও আমার কপালে ছিলনা, কারণ, জন্মের কয়েক মাস আগে যুদ্ধকালীন শর্ট-সর্ভ়িস কমিশনের অফ়িসর, দু’নম্বর স্কোয়াড্রনের নেতা, পিতৃদেবকে তদানীন্তন সরকার বাহাদুর আরব্য উপন্যাসের জিন-পরির মত নিচের জবর জবর তিন বরের যে কোনও একটা বেছে নিতে বলেন:

(এক)  স্বক্ষেত্রে পাকাপাকি কমিশন,

(দুই)   কর্তৃপক্ষের সুবিধেমত তুল্যমূল্য অন্য কোনও সরকারি কাজ, অথবা

(তিন) পূর্ণ স্বরাজ৷

আমাদের পরিবারে, একটু আধটু ফুটানিই যা ছিল (রবিবার সকালে আকাশ ভেঙে পড়লেও লুচি হত, সিভিলিয়ান জীবনে বাবা সর্বদা ধোপদুরস্ত সাদা ধুতি পঞ্জাবি পরতেন — প্যান্ট শার্টের চেয়ে সস্তা বলে), বসে খাবার মত রেস্ত ছিল না৷ তায় আবার তখন সদ্য সদ্য যুদ্ধ শেষ হয়েছে, ওদিকে নিজের সংসার হয়েছে, একটি সন্তান হব হব৷ তিনি স্ববুদ্ধিতে পার্মানেন্ট কমিশনের হাতছানি উপেক্ষা করে, বাকি দুই বরের আপেক্ষিক ওজন যাচাই করতে, দিল্লির পতৌদি হাউসে সাময়িক আশ্রয় নিয়ে মাকে রেখে এলেন কলকাতার বাড়িতে৷

দুটো সুযোগ তাঁর সামনে সহজে এলো: বিশ্বযুদ্ধের পিঠোপিঠি, অশালীন ইয়ার্কির মত সেই ধর্মীয় সংঘাতের আবহাওয়ায়, আকাশবাণী ঢাকার স্টেশন ডিরেক্টরের পদ (বাবার জবানিতে, “অভ় অল প্লেসেজ়…!”) এবং, স্বচেষ্টায়, কলকাতার চল্লিশ মাইলের মধ্যে নাতিবৃহৎ, কিন্তু যুদ্ধাবকাশে ক্রমবর্ধমান এবং যুদ্ধান্তেও সম্ভাবনাময়, এক বেসরকারি কারখানায় জনৈক মানবসম্পদ আধিকারিকের দায়িত্ব, যদিও গালভরা সেই পদনাম তৈরি হয়নি তখনও৷ স্বভাবতই, প্রথমটাকে উপেক্ষা করে তিনি নিজের স্বকীয় মেধা, অধীত বিদ্যা এবং অর্জিত অভিজ্ঞতার অনুপযোগী সেই মফসসলের বৃত্তিটাই বেছেছিলেন; হাতে সময়ও ছিল না৷

উনিশশো ছেচল্লিশের পয়লা নভ়েম্বর তিনি কাজে যোগ দেন; সেই আঠেরোই মায়ের ডাক্তার শ্বশুরের হাতে আমার জন্ম — হাসপাতালে নয়, তাঁরই কলকাতার বাসায়, মায়ের নিভৃত শয়নকক্ষে৷ অন্য চোখে দেখলে, রুশদি যাদের মধ্যরাত্রির সন্তান  বলেছেন, রূপকার্থে তাদের চেয়ে আমি এক গর্ভবাসকাল বড় — নিঃসন্দেহে বেবি বুমারদের একজন৷ তার কিছুদিন পরই নবজাতকসহ মাকে শান্তিনিকেতনে পাঠিয়ে দেয়া হয়, শ্রীপল্লিতে, তাঁর দাদামশাই-দিদিমার কাছে: হয়ত লীগের প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক এবং ন্যক্কারজনক রক্তক্ষয় এড়াতে, হয়ত মায়ের শরীর সারানোর জন্য৷

শান্তিনিকেতনেই বিয়ে হয়েছিল মায়ের, বীরেনদার বাড়িতে৷ দাদার (ক্ষিতিমোহন সেন) শ্রীপল্লির বাড়ি তখন হয়তো হচ্ছে বা সবে হয়েছে৷ পাশেই অমিতাদির বাড়িতে কিছুদিন থাকতেন তাঁরা তদারকির ইচ্ছায়৷ গুরুপল্লির মৃন্ময় কুটির ছেড়ে নির্মীয়মান পাকাবাড়ি তৈরি যখন শেষ হয়, দাদা-দাদির ঘরে বৈদ্যুতিক পাখা লাগাবার সময় বাবা উপস্থিত ছিলেন বলে শুনেছি; লাগানো হয়ে গেলে দাদি (কিরণবালা) বাবাকে বললেন, “ছবি, ওনার এই লাঠিটা দিয়ে দূর থেকে পাখার সুইচটা চালিয়ে দিয়েই দৌড়ে পালিয়ে এস; ঘন্টা খানেক খালি ঘরেই চলুক, যদি ভেঙে পড়ে যায়!”

শুনেছি, বীরেনদার বাড়ির প্রবেশপথ পাতাসমেত স্থানীয় কমলালেবু (পাতি লেবুর মতই আকার তাদের, দেখনহাসি, ভক্ষণের মত জৈব ক্রিয়ার ঊর্ধ্বে) আর অর্ধস্ফূট পদ্ম দিয়ে সাজানো হয়েছিল৷ সে সজ্জায় এবং আলিম্পনে কলাভবনের হাত ছিল শুনেছি — অন্তত যমুনাদির ছিল৷ বিয়ের অনবদ্য পিঁড়িটাও কি তিনি এঁকেছিলেন? খুব সুন্দর, কিন্তু রংটা তেমন পাকা ছিল না; শুনেছি, অন্নপ্রাশনের দিন তাতে বসানো হয়েছিল তখনও টয়লেট-আনট্রেন্ড আমাকে — সেটা গুজবও হতে পারে অবশ্য! তবে রংটা যে ধ্যাবড়া হয়ে গিয়েছিল, তাতে সন্দেহ নেই। নন্দলাল উপহার দিয়েছিলেন স্বহস্তে জলরঙে আঁকা গৌরবর্ণ আর্য  ও মেঘবরণ শ্যামলী’র ছবি, বাবার আর মায়ের নামানুযায়ী, শুধু সকৌতুকে বাস্তবের গায়ের রং ওলটপালট করে৷ গগনেন্দ্রনাথেরও একটা আন্দাজ ৬”x৯” জলরং, আধা কিউবিস্ট ঢঙে আঁকা ‘পদ্মপত্রে জল’, মায়ের আলমারির বাঁ দিকের ওপরের দেরাজে থাকত; ফ্রেমবদ্ধ হয় নি কখনও। সেটা বিয়ের উপহার না অন্য কোনও ভাবে পাওয়া, জানা হয়নি কোনও দিন। সেই দেরাজেই ছিল তক্ষশীলার থেকে পাওয়া একটা গান্ধারযুগের সুবর্ণ মেডালিয়নের (না কি সেটা স্বাক্ষরপ্রতীম সীল!) ডিম্বাকার প্লাস্টার কাস্ট — ক্ষুদ্রব্যাস এক ইঞ্চি, বৃহদ্ব্যাস ইঞ্চি দেড়েক — বাবার যুদ্ধকালীন সংগ্রহের অন্যতম। মেডালিয়নটা, শুনেছি, এখনও আছে; তবে সেই পদ্মপত্র বহুকাল কেউ দেখেনি, উদ্বায়ী জল উবে গেছে হয়ত। সেই আলমারির অন্যত্র ছিল মেহগনি কাঠের বর্মি ওয়াকিং স্টিক, আসলে কাজিয়া করার লায়েক, দ্বি-ধার গুপ্তি; সেটাও বাবার ওয়র বুটি। হাতল দিয়ে সাতটা নিষিদ্ধ মাপের গুলি ভরা যায় এমন একটা জর্মন মাউজ়ার পিস্তলও আমৃত্যু ছিল বাবার জিম্মায়; সেটা যে কোথায় পেয়েছিলেন জিজ্ঞেস করিনি কখনও। বাবা মারা যাবার পর, আইন মোতাবেক রডা কোম্পানির জিম্মায় ছিল সেটা; পরে মহারাজ মেসো আইনসঙ্গত ভাবেই কিনে নেন৷ আকিয়াব থেকে তুলে আনা কাল-গোত্রহীন বুদ্ধের একটা ছিন্নমস্ত (সেটাও শুনেছি স্থানীয় রীতিবিরুদ্ধভাবে লম্বকর্ণ) ফেলে আসতে হয় বলে সারা জীবন বাবার দুঃখ ছিল, যদিও আমার ঠাকুমার নিজস্ব সংস্কারে গৃহীর ঘরে বুদ্ধমূর্তি রাখা খারাপ। সেই সংস্কারভঙ্গের দায়েই নাকি কয়েক বছর পর তাঁর ভাই, ছট্টি (ডাক্তার এস.কে. সেন)-এর মৃত্যু হয় — দোতলার সিঁড়ি থেকে ঠায় একতলার ল্যান্ডিঙে পড়ে গিয়ে, যেখানে স্থাপিত ছিল একটা অর্বাচীন বুদ্ধমূর্তি। …

… আমার আড়াই বছর বয়স অবধি মা কিংবা আমি বাবার শা’গঞ্জের আস্তানা দেখিনি৷

তারই মধ্যে নাকি আমার ভারত পরিক্রমা শুরু: কখনও লখনৌতে মায়ের মেজমাসির (মমতা দাশগুপ্ত, ডাকনাম লাবু) বাড়ি; কখনও নালন্দার নবোত্থিত ধ্বংসস্তুপের মধ্যে — সেখানে বাবা কিছুটা পর্যটক আর বাকিটা প্রত্নতত্ত্বের নিযুক্ত বেসরকারি আলোকচিত্রী (রোলিকর্ড ২.৬ টি.এল.আর.-এ খুব কম স্পীডের সাদাকালো কোড্যাকে স্বহস্তে তোলা এবং প্রস্ফূটিত; প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রকাশিত ‘মার্গ’ সাময়িকীতে তার কিছু ছাপা হয়েছিল, আর নালন্দাবিষয়ক বাংলা এক ইতিহাস পুস্তকে একটা); কখনও বা দু’পা দূরের পুরী কোনার্ক ভুবনেশ্বর৷ সেই পরিক্রমার দু’একটা হয়ত শা’গঞ্জে থিতু হওয়ার অব্যবহিত পর পর৷ জ্যেঠা বাবাকে বলতেন, “ছবি, তোর পায়ের তলার চাকাগুলো খোল”৷

যতদিন বেঁচেছিলেন, লাবুদি — মায়ের সেই লক্ষ্মণাবতীয় মেজমাসি — আমার এক বছর বয়সের ওজন নিয়ে খোঁটা দিতেন; কোলে তুলতে হয়েছিল তো বেশ কয়েক বার! এখনও তাঁর বড় মেয়ে, ইলিনামাসি, শত ব্যক্তিগত দুঃখের মধ্যেও সে কথা স্মরণ করেন৷ আর লাবুদি সপরিবারে খোঁটা দিতেন আমার প্রাক্–যুক্তাক্ষর শিবরাম পাঠ নিয়ে — সেটা নিশ্চয়ই পরের ঘটনা: শিবরামের লেখা কোনো কেতাবের শিরোনাম নাকি আমি পড়েছিলাম, বি.শ.ব.প.তি  বা.বু.র  অ.শ.ব.ত.র  প্রা.পি.ত — তা সে আমার হাতেখড়ির ঢের আগে!

… কলেজজীবনে মুক্তারাম বাবু স্ট্রীটে তাঁর মেসঘরে দেখা করতে গিয়েছিলাম এক বার, আমার বন্ধু আশিস (পিটু) সেন আর সেবারের পত্রিকা সম্পাদক সুকোমলের সঙ্গে; যুক্তাক্ষরের গল্পটা সভয়ে বলেছিলাম৷ আশিসের স্বর্গত পিতাঠাকুর ছিলেন এক স্বনামধন্য কবিরাজ; গিরিশ পার্কের কাছে তাঁর ভদ্রাসন ও ডিসপেন্সারির নাম কল্পতরু; শিবরাম তাঁকে বিলক্ষণ চিনতেন! আমায় বললেন, “ওহে অযৌক্তিক  পাঠক, লেখা নেবে তো কল্পতরু-র আশিস  চাও, সুকোমল  করে লিখে দেব!” অসামান্য সেই তাৎক্ষণিক শিব্রামোক্তি স্মরণ ছিলনা এতদিন৷ সেদিন, বালিগঞ্জ ট্রাম ডিপোর কাছে আমার লাইব্রেরি থেকে রমণী চাটুজ্জে স্ট্রীট অবধি হাঁটা পথে, বড্ড বেশি বুড়িয়ে যাওয়া আমারই সমনামী এক সহপাঠীর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হতে, একথা সেকথায় সে মনে করিয়ে দিল৷ কি করে ভুলে ছিলাম রসশব্দের জাদুকরের সে রসোক্তি!

অযৌক্তিক সেই মলাট-পাঠের ঘটনা শান্তিনিকেতনের বলে আমার সন্দেহ, কারণ সে উপাখ্যানের অনেক শাখাপ্রশাখা, অনেক অশান্তিজনক সাক্ষী৷ যমুনাদি সেবকদা প্রফুল্লদা পর্যন্ত অসমসাময়িক এক জ্যান্ত বেড়ালের লেজের ললালোলি, থুড়ি, নড়ানড়ি  সম্পর্কিত অন্য এক গল্প বলতেন অশ্বতরের সঙ্গে সনিঃশ্বাসে — নিমাইমামা তার সাক্ষী৷ সেই সময়েরই আরেকটা ঘটনা গোঁসাইজিকে (নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী) ঘিরে৷ একদিন যখন সেই বিরলকেশ, শ্বেতশুভ্র গুম্ফশ্মশ্রুময় সদাশয় ব্যক্তিটি মা বাবার সঙ্গে দেখা হতে কুশল বিনিময় করছেন, তে সম্পৃক্ত আমি নাকি গ্রীক নাটকের রীতি অনুযায়ী সোচ্চার জনান্তিকে মাকে শুধিয়েছিলাম, “ইনি উদো, না বুধো?” আমার কি দোষ… হাতে না হয় ট্রেডমার্ক হুঁকোটা ছিল না! যদ্দূর জানি, কথাটা গোঁসাইজির কানে গিয়েছিল — যাবারই কথা; তা সত্ত্বেও পরে আমাকে তাঁর স্বাক্ষরিত ছেলেভুলানো ছড়া  এক কপি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সস্নেহে৷

মায়ের ছোটমাসি, অমিতাদিও মৃত্যুর কয়েক বছর আগে, অন্যান্য অপ্রকাশ্য উপাখ্যানের সঙ্গে, এই সব গল্প আমার কনিষ্ঠা কন্যাকে ফলাও করে বলেছেন৷ এতেই বোঝা যাচ্ছে, দিনের আলোর মত স্পষ্ট, মাতৃকুলে আমার প্রসিদ্ধি প্রধানত বিদূষক হিসেবে৷ এই ভূমিকাটা পিতৃদেবেরও পছন্দের; তিনি বলতেন, “রসবোধের সেরা হল সেন্স অভ় হিউমর, ওটা বাদ দিলে মানুষ গোরিলা হয়ে যায়৷”

আত্মজীবনী লেখার চেষ্টায় এ রচনা নয়৷ আটপৌরে সাদামাটা কীর্তিহীনের জীবন নিয়ে আত্মজীবনী চলেনা; পড়বে কে, রচনাই বা লিখবে কারা: “এই যে জোনাকি, ইহাদেরও মৃত্যু আছে; তাইতো কবি বলেছেন…”! কিছু আজব ঘটনা, যার পারম্পর্য এবং স্থানকালের আইনস্টাইনীয় সম্পর্ক আমার কাছে বেজায় বিদঘুটে ঠেকে, মাঝে মাঝে বেজায় মজার, গুনে গুনে পাঁচজনের সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার জন্য স্মৃতিকথা লিখতে শুরু করেছিলাম আমার ওয়েব লগে — প্রথমে ইংরেজিতে, পরে বাংলায় — ওয়েব বা উর্ণাজালের মত তিল তিল করে বোনা স্মৃতি সব, আপাতবিস্মরণের অতল সমুদ্র থেকে খুঁজে আনা৷

যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে থাকার ইচ্ছে আমার নেই, তবে সেই সরস মুহূর্তগুলোকে কি একটু বাড়তি জীবন দেয়া যায়না!

এই বর্ধিত লেখাটা আমার নিজের সঙ্গে আলাপচারি; বলা উচিত, ফ়্রেমবদ্ধ অল্প একটু সময়ের ক্যামিও স্মৃতিচারণ৷ তবে ডায়রি রাখিনি কখনও, অনেক দরকারি ঘটনা বেমালুম লোপাট; অকিঞ্চিৎকর বহু ঘটনার বিরক্তিকর খুঁটিনাটি কিন্তু ভুলিনি! যেগুলো স্পষ্ট মনে আছে ভাবছি, সেগুলো হয়তো আত্মপ্রতারণা৷ আর মনের ফাইলিং সিস্টেমটাও গোলমেলে — চাইলেই হদিস মেলে না; যখন মেলে তখন তারা সময়ক্রম, ঘটনাক্রম, ধারাবাহিকতা বজায় রাখে না মোটে, কেমন কাটা কাটা — ধীরগতির ব্রডব্যান্ডে ইউটিউবের ছবির মত৷

তা বলে কি বলব না ছোটমার তৈরি সেই হারিয়ে যাওয়া জিরে চিঁড়ের কথা: চিঁড়ের মত পাতলা আর সরু করে কাটা নারকেল কুচি অল্প আঁচে শুকিয়ে নিয়ে চিনির রসে ফুরফুরে করে আসানো — তাতে রং ধরবেনা একটুও! কিংবা খোকনদা স্বপনদার পিসি, যাঁকে পপ বলতাম আমরা যুগল অকারান্তে, তাঁর রান্না লইট্ঠার শুঁটকি! অথবা জি.টি. রোডের থেকে একটু ভেতরে, আদিসপ্তগ্রাম স্টেশনের কাছাকাছি কিন্তু উল্টোবাগে, সরস্বতীর শুকনো খাতের অনেকটা তফাতে সেই পানাচ্ছন্ন মজা বাঁওড়, হয়তো সাবেক সরস্বতীরই কোনো কন্যা ধারা, আর বাঘ বাঁওড়  নামের গ্রাম, যেখানে প্যাট্রিক — আমার আঠেরো বছর বয়সে পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই ড্রাইভ়িং শিক্ষার গুরু — তার চেনা এক মহিলার কুটিরে নিয়ে গিয়েছিল গাড়ি খারাপ হতে৷ সেরকম সবুজ গ্রাম, ডোবা ভরা শালুক, ডোবার ধারে লুচি পাতা (টাকাপ্রমাণ গোল, ভাজলে লুচির মতই ফোলে, মা পাতলা চালপিটুলিতে চুবিয়ে মাঝেমাঝেই ভাজতেন; বর্ষায় খিচুড়ির পাতে খাসা!) আর টক টক আমরুলি পাতার (কুন্ডু পুকুরের পারেও অনেক হত, আমরা কোঁচর ভরে তুলে সানন্দে চিবোতাম) কার্পেট, গুটি সুদ্ধ পুঁই আর বনকলমির ঝাড়, আমার বুকের হাইটে ঝুলে থাকা কাঁঠাল, রেবেকামাসির ছিটেবেড়ায় লতানে মাকাল পেকে লাল টুকটুক করছে, আর চন্ডীমন্ডপের মত খোড়ো চার্চ — তার মাথায় ফুটিফাটা কাঠের ক্রস — এসব তো আর দেখবে না কেউ সর্বগ্রাসী বাজার অর্থনীতির দৌলতে!

বাংলার কয়েকটা গ্রাম, দু’একটা শহরতলি আর একটা মাত্র মহানগরের কথা, যা অনেক দেখেও আমার আশ মেটে নি এখনও, সেটা অগোছালো হলেও লিখে ফেলতে ক্ষতি কি? একটা ঝাপসা মত ছবি তো ফুটবে! কেউ পড়ুক, না পড়ুক, আজ জোনাকিদের কথা লিখব বলে আমি বদ্ধপরিকর৷

কিছু মানুষের নাম দরকার মত — আবরুর খাতিরে কিংবা অন্য কারণে — পাল্টাতে হয়েছে, উহ্য কিংবা সংকেতে রেখেছি কয়েকটা৷ পেছন থেকে ছোবল মারা সাপ, ঝোপেজঙ্গলে লুকোনো গেল-গেল-সব-গেল হাঁকা ফেউ আর মড়াখেকো নরকের কীটদের ক্ষেত্রেই সেসব বিধিনিষেধ৷ বাকিরা প্রায় সবাই স্বস্থানে স্বমহিমায় আছেন৷ সাহস করে এই অপটু, অগোছালো লেখা পড়বেন যাঁরা তাঁদের জেনে রাখা ভালো, এই স্মৃতিকথা প্রামাণিক তথ্যনির্ভর নয় — এর ওপর ভরসা করে মামলা করলে ধোপে টিঁকবে না৷ এমনকি, যে কবিতার উদ্ধৃতিগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সেগুলো যাচাই করবার কোনও উপায় নেই আমার, কারণ বইগুলোর অধিকাংশ আমার সহজ সংগ্রহের মধ্যে নেই৷

শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির একটা বয়সে হামের মত কবিতাজ্বর হবেই হবে, তার কোনও প্রতিষেধক নেই; তেমনি আবার কবিতাবয়সে দুঃখবিলাসের আমবাত বেরোয়নি এমন বাঙালি বিরল৷ খুকুমাসি, মায়েদের চার বোনের সবচেয়ে ছোট, নিবিড় শৈশবে, জুতো-মোজা পায়ে থাকা সত্বেও, ডুকরে কেঁদে উঠেছিল একদিন, “কালিপা কন কন কন!” কেন, সে রহস্য ভেদ হয় নি কখনও। তার অল্পদিনের মধ্যেই অসামান্য শ্রুতি ও স্মৃতিশক্তির নিদর্শন রেখেছিল… “তোর দিদিরা কি কি বই পড়ে রে?” “ছাছতো ছোপান, নীতি ছুদা আর হাইটোছ অভ় ইটলিচার!

কৈশোরে কবিতা ভ়াইরাসের প্রকোপে দুঃখের পদ্য লিখতে বসে যেই লিখেছে মাতৃহারা মা যদি না পায়, অমনি পেছন থেকে কঙ্করদা (ক্ষিতিমোহনের ছেলে, ক্ষেমেন্দ্রমোহন, শান্ত-শিবের বাবা) উচ্চৈঃস্বরে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে মিলিয়ে দিয়েছিলেন পিতৃহারা পা পাবে কোথায়!

মাতৃহারার মা আর পিতৃহারার পায়ের মত হাসি আর কান্নাও যে পাশাপাশি থাকে, রামশর্মা নামধেয় জনৈকের কল্যাণে তা কি জানতে বাকি আছে কারু! আমার জীবনেও হরিষের চেয়ে বিষাদের ভাগ কম নয়, মিলিয়ে মিশিয়ে হরিষে বিষাদ! আমি হরিষের কথা সহাস্যে বলব, বিষাদের কথাও সরসে; দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বক্ষবাদক গোরিলা হওয়ার ইচ্ছে নেই মোটেই৷

মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যে সুখি আর দুখি জীবনদোলায় দুলছে, তারা যে আসলে একই লোক সে কথা গীতিকার খোলসা করে বলেননি৷ কেনই বা বলবেন; ধ্রুব সত্য কি কেউ দিব্যি গেলে এস্ট্যাবলিশ করে!

###

মোরা নাচি ফুলে ফুলে

ছেলেবেলায় কেউ কেউ আমাকে অকালপক্ব বলতেন৷ হয়তো তাঁদের সাত পুরনো ছেলেভুলোনো রসিকতায় হাসতাম না আমি; হয়তো যাঁরা আমার অপক্ববুদ্ধির খাতিরে আধো আধো বুলিতে কথা বলতেন — যেমন করে কুকুরছানার সঙ্গে কথা বলে কেউ কেউ — তাঁদের দেখলে আমার কচি কপাল ভ্রুকুটিকুটিল হয়ে উঠত; হয়তো আমার নিত্যনতুন শব্দের সঞ্চয়, যা অবশ্যই বয়স্যদের গুলি-টল-লেত্তি-লাটিম, টিনের বরকন্দাজ এবং ডিংকি গাড়ির সংগ্রহের চেয়ে ঢের বেশি সমৃদ্ধ ছিল, বিব্রত করত তাঁদের৷ তা বলে কি সত্যি এঁচোড়ে পাকা ছিলাম!

প্রায় একবছর সাংঘাতিক কামলায় কাবু হয়ে, দীর্ঘ গৃহবন্দিত্বের পর কোম্পানির বাংলা স্কুলের পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হলাম ১৯৫৫-তে, সে অবশ্য আমার দ্বিতীয় স্কুল যাত্রা৷ নতুন স্কুলে তখন সরকারী ত্রিভাষিক নীতি চালু৷ বাংলা অবশ্যই আমার প্রথম ভাষা, ইংরেজি দ্বিতীয়; তৃতীয় ভাষা হিসেবে বাবা আমার হয়ে বাছলেন সংস্কৃত — সে স্কুলে তার একমাত্র বিকল্প ছিল হিন্দি৷ পরে আবার হিন্দিকেও আবশ্যিক ঘোষণা করে বৎসরান্তে বাতিল করা হল নেহরুর তৎকালীন ভাষাভিত্তিক দ্বিধার দরুন; তবে সে অন্য গল্প, রাজনীতির গল্প৷ তার আগে ১৯৫১-তে চার বছর বয়স পুরতে না পুরতে ভর্তি হয়েছিলাম মিসেস ডি’ক্রুজের এলেবেলে স্কুলে, পড়েছিলাম ১৯৫৩ পর্যন্ত৷

বলছি বটে এলেবেলে, কিন্তু সেখানেই আমার ভাষা শিক্ষার উন্মেষ আর ইতিহাস প্রীতির আরম্ভ; আন্টি ডি’ক্রুজ়ের (ফ্লোরেন্স ডি’ক্রুজ়) এবং, ব্রেন্ডার কচি বয়সে অল্প কিছুদিনের জন্য তাঁর মায়ের, মত পড়ানোর সহজ ঢং আমি আর কখনও দেখিনি। মায়ের আলমারিতে অনেক পুরনো দস্তাবেজের সঙ্গে তোলা ছিল আমার সেই এলেবেলে স্কুলের খাতাপত্র। মায়ের মৃত্যুর পর সেগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম। ইজিপ্টের ভূগোল শিখতে গিয়ে নাইলের বিচিত্র গতিপথ তো বটেই, অধিকন্তু শিখেছিলাম ফ্যারাও সাম্রাজ্যের প্রথম হিয়েটাসের কথা৷

সেই লব্ধ জ্ঞানের সঙ্গে জুড়েছিল আমার গভীর কামলার সেই বছরটা যা আমাকে গৃহবন্দী রেখে পাঠতৃষ্ণা বাড়িয়ে দিয়েছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ঢের বেশি হয়ত। ফলে বাংলা স্কুলে অঙ্ক-অনভিজ্ঞ আমি অনেকটা বাড়তি প্রজ্ঞা নিয়ে এসেছিলাম; নিজে নিজেই শিখে নিয়েছিলাম সেই প্রজ্ঞার দন্তনখরাদি সযত্নে লুকিয়ে রাখতে। বুদ্ধ-সিদ্ধার্থরও কামলা হয়েছিল; তাঁকে সারিয়ে তুলেছিলেন ভিষকরাজ জীবক। তাইতে আমার ঠাকুমা বলতেন, “আমার এই নাতি স্বয়ং বুদ্ধদেব!” …

তারও অনেক আগে নাকি আমার অক্ষর পরিচয় — বাংলা অক্ষর — যে সব ছড়া বা সহজ গপ্পের বই কণ্ঠস্থ ছিল তার চিহ্ন দেখে দেখে, আর গ্র্যামোফোনের রেকর্ড পরিচিতির দৌলতে৷ এবং সেই সঙ্গে কবিত্বের উন্মেষ, যা আমাকে টা-টা বলে বিদায় নিয়েছে ভালো করে বড় হওয়ার আগেই৷ শুনেছি, তারও আগে, আমি নিজের মনে বলতাম “আবোল তাবোল বইঃ,/ খ্যাপার গানের গইঃ”৷ গুঢ়ার্থের খোঁজ করবেন না, প্লীজ়়, আর বিসর্গ দুটো ফাউ! একদা নাকি, গুরুগম্ভীর, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বলেছিলাম, “মহাভারতের আঁধার হল গতন গতন,/ খোলো দ্বার রঘু, বঘু বঘু!” ওই বঘু বঘু টুকু বাদ দিলে বাকিটা সহজবোধ্য; আর ছন্দ সৌকর্যে কোনও ছান্দসিক, স্বয়ং প্রবোধ সেনও খুঁত ধরতে পারতেন না৷ তাইতে ঠাকুমা বলতেন, “ক্ষণজন্মা!” বেঁচে থাক আমার পিতৃকুল!

“অস্তি গোদাবরিতীরে বিশাল শাল্মলী তরু…”

এখন বুকে হাত রেখে বলতে পারব না গল্পটা কোন শ্রেণীতে পড়েছিলাম, পঞ্চম না ষষ্ঠ! সেই শিমুল গাছটার শাখায় শাখায় ছিল মেলাই পাখির বাসা৷ আর মনে করতে পারছি না একটা বুদ্ধিমন্ত কাকের গল্প, যে জাপানি বোমারু পাইলটের মত, সাবুরো সাকাইয়ের মত, মিৎসুবিশি জ়িরো বিমানের সাহায্য ব্যতিরেকেই, অভ্রান্ত লক্ষ্যভেদ করত বারংবার (কাকেন পুরীষোৎসর্গং কৃত্বা পলায়মাস), সেটা হিতোপদেশ পাঠ-এর একই কাহিনির অঙ্গ না অন্য উপাখ্যান! স্কুলজীবন শুরু হবার ঢের আগে থেকে সেই বয়ানগুলো শুনে শুনে আমার কণ্ঠস্থ ছিল৷ এখনও চোখ বুজলে দেখতে পাই আমার চেয়ে বেশ কিছুটা বড়ো এক সম্পর্কে জ্যেঠতুতো দাদা ঝুল পড়া, ন্যাংটো এবং একলা বিজলি বাতির নিচে দুলে দুলে সরল হিতোপদেশ পাঠ মুখস্থ করছে — উচ্চপাঠের সেই হিন্দোল আমার রসানুসন্ধানের পাথেয় হয়ে রয়েছে সেই শিশুর মত, যে নতুন মন্দিরের জন্য তার দোলনটুকু দিয়ে দিয়েছিল (অলোকরঞ্জন, মাপ করবেন)৷ এঁদো বাড়ি, দিনের বেলাতেও অন্ধকার, তবে সেটা পয়োগ্রামের অভ্যস্ত ভদ্রাসনের বদলে পাওয়া ব্যারাকপুরের অযুত আরশুলা অধ্যুষিত প্রাক্-মিউটিনি প্রাসাদ, যেটা পরে গঙ্গাগর্ভে বিলীন, না বৌবাজারের বাড়ির ভেতরেও অন্ধগলির বহুকক্ষের ভুলভুলাইয়ার একটা, তা মনে পড়ে না শত চেষ্টাতেও৷ পয়োগ্রামের সেই সুখের আলয়, অভ্যস্ত আস্তানা, তাদের কয়েক পুরুষের ভিটে, তখন সীমান্ত ছাড়িয়ে এক ভ়িসা পথ দূর —  প্রায় চাঁদের কাছাকাছি৷

চোখ বুজে আমি সেই গোদাবরী নদী দেখতে পেতাম, শিশু চোখে তখনও ভালো-খারাপ-মাঝারি কোনও জ্ঞানাঞ্জনই লাগেনি — তাই অপাপবিদ্ধ দেখা৷ ইন্ডিয়ান অফ়়িসার্স’ কোয়ার্টার (আই.ও.কিউ.)-এর উত্তরে, কারখানা সীমায়, ছিল একটা বড়ো নালা, উৎপাদনের বর্জ্য জল সেই নালাবাহিত হয়ে একটা ঘরে পরিশোধিত হতো, তারপর পড়ত একটা বিশাল পাইপের মুখে; পাইপটা বিষোদ্গারের লজ্জায় সীতার মত পাতালে প্রবেশ করে ফেনায় ফেনায় উদ্ধত, অপেক্ষাকৃত কম বিষাক্ত জল উদগার করত ভাগীরথীবক্ষে — দূষণের আইন কানুন তখন আলগা ছিল আরও৷ পাঁচ নম্বরের চিত্তকাকা ফেনা  শুনলেই আমার নাম জড়িয়ে বলতেন “ফাল্গুনে গগনে ফেনে ণত্বমিচ্ছন্তি বর্বরাঃ” — সেই আমার ব্যাকরণ শিক্ষার শুরু! তবে নিতান্তই পল্লবগ্রাহী সেই শিক্ষা, কারণ দীর্ঘকাল আমার ধারণা ছিল চর্মচটিকা মানে চামড়ার চটি, তৈজসপত্র  মানে তেজপাতা, আর, কেন জানিনা, মনে হত, কেলেঙ্কারি আর ইদানীং শব্দ দুটি ইংরেজি থেকে আমদানি; পক্ষান্তরে, দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, মোচার ইংরেজি কলিফ্লাওয়ার, কারণ গুরবচ্চন বলত কেলা কা ফুল৷

আই.ও.কিউ. পিতৃদেবের তদানীন্তন হাল সাকিন, অবশ্যই কোম্পানি প্রদত্ত, শা’গঞ্জে তাঁর দ্বিতীয়৷ প্রথমটা, সিনেমাপারের সেই স্টাফ় কোয়ার্টার (১৭২ নম্বর কি?), প্রথমে ছিল বাবা আর খোকাদার যুগ্ম দখলে, পরে খোকাদার একার। যারপরনাই সুন্দরী এবং যুবতী মায়ের সঙ্গে আড়াই বছরের আমি প্রথম সেই বারো নম্বর কোয়ার্টার দেখি, আগেই বলেছি জ্ঞানাঞ্জনহীন চোখে৷ মা আমার চেয়ে কুড়ি বছরের বড়ো, আমার নাতিযুবক বাবা মায়ের চেয়ে চোদ্দ বছরের৷  জন্মে  ইস্তক শুনেছি সেটা প্রেমবিবাহ —  আজ  মনে  হয় শুরুতে হয়তো একতরফা

প্রেম ছিল সেটা৷

আই.ও.কিউ. নামটা পোশাকি, বোধহয় চটকল আমলের, কোম্পানির দস্তাবেজে অনেক পরে দেখেছি৷ আমাদের সময়ে লোকে বলত, “ওই যে, নদীর ধারে বারো কোয়ার্টার!” ব্যান্ডেলে ট্রেন থেকে নেমে রিকশাওয়ালাদেরও তাই বলতে হত৷ বাবারটা ছিল বারোটা আজব একতলা বাড়ির শেষের গৃহ: দুটো শয়নাগার, ভাঁড়ার (পেটপুজোর রসদের বদলে সেটা ছিল বাবার আলোকচিত্রীয় অন্ধকূপ) আর রসুই, বসা-খাওয়ার জায়গা, আর একটা জালে মোড়া পিছবারান্দা — শীত কালে দিব্যি তেল মেখে রোদ পোয়ানো যেত উত্তুরে হাওয়া সত্ত্বেও৷ সেখানে রাখা থাকত দস্তার লাইনিং দেয়া কাঁঠাল কাঠের একটা আইস বক্স, সবুজ রং করা। রোজ সকালে ভ়্যান রিকশায় এক চাঙড় বরফ আসত তার শীতলতা বজায় রাখতে। বাক্সের পেছনে একটা সরু নল ছিল গলা জল নির্গমনের জন্য, তাই পিছবারান্দায় স্থান হয়েছিল তার। বাজারে পছন্দ মত মাছের চালান অনিশ্চিত, রাধা সিঙের দোকানে হপ্তায় তিন দিন পাঁঠা কাটা হত — তাও একেকদিন একটু দেরি হয়ে গেলে খতম। তাছাড়া একতলা বাড়িটায় গরমও ছিল খুব; সোলান নাম্বার ওয়ানের খালি বোতলে জল ভরে অথবা ভ়িমটো আর লেমনেড ঠান্ডা করা হত সেই ফ্রিজপূর্ব যুগে।

বাবা বলতেন, “অসুবিধে একটাই, কারণ স্নানঘর ইয়েঘরও একটা; এখানেও তুমি বাহির থেকে দিলে বিষম তাড়া!” কলকাতার বাড়িতেও ছিল সবেধন নীলমনি একটি মাত্র বাথরুম, তাও নির্জলা — কলঘর থেকে মগে করে পেতলের গাড়ু ভরে নিয়ে যেতে হত; নয়তো পরমাত্মীয় কোনও যোগানদার মারফত! পরে এস্টেটের যে বাড়িতে বাবার আমৃত্যু ছিলাম আমরা, সেখানেও সেই বিষম তাড়া  বাবার সঙ্গ ছাড়েনি৷ পিছবারান্দার ওপাশে বাঁধানো উঠোন আর ডাকটিকিটের চেয়ে অনেকটাই বড়ো বাগান একটা — কেষ্ট মালির দৌলতে বছরভর সপুষ্পক৷ বাগানের উত্তর সীমায় বর্শা গাঁথা পাচিল, পাচিলের ওপারে একটা তেপান্তরের মাঠ, স্থানীয় জলকলের সম্পত্তি; সেখানে মাঝে মাঝে স্কাউট ও গাইডদের শিক্ষানবিশি কুচকাওয়াজ হত৷

বারোটা একতলা বাড়ি পাশাপাশি তবু ঠিক জ্যামিতিক রেখায় ছিলনা — কোনওটা আগু, কোনওটা পিছু, কোথাও কোথাও অনেকটা ফাঁক৷ স্মৃতি যদি প্রতারণা না করে তবে পাঁচ ও ছয় সংখ্যক বাড়ির মধ্যে ছিল বিস্তর অন্তর — হয়ত একটা গোটা সাড়ে পাঁচ নম্বরের জায়গা হত সেখানে৷ সেখানে সযত্নে অযত্নে বেড়ে উঠেছিল বিস্তর শিউলি, বকুল, হাস্নুহানা, অশোক, নাম না জানা অনেক গাছ, আর একটা একলা কদম, তার ক্ষীরকদম্বের মত ফুল বর্ষার পিচের রাস্তায় হেলাফেলায় ছড়িয়ে থাকত আর ততোধিক হেলাফেলায় পদপিষ্ট হত করুণাহীনতায়৷ পিটুলি গাছটা কেউ পোতেনি, কাকবিষ্ঠায় গজিয়েছিল হয়ত তার অবাঞ্ছিত শুঁয়োপোকার সম্ভার নিয়ে — নিশ্চয়ই সেই চটকলের যুগ থেকে, এত বুড়ো!

প্রতিটি গাছে অসংখ্য পাখির বাসা, তারা এতো বাঙ্ময়, এতো সশব্দ, যে হয়তো তাদের কথা ভেবেই কবি লিখেছিলেন এতোটুকু যন্ত্র হতে এতো শব্দ হয়!  কর্মব্যস্ত ও কলহপরায়ণ বিহঙ্গ-চীৎকার  রবিবার  ভোরেও  থামত না,  আমার  নিদ্রাপিপাসু বাবা-মা পাশ ফিরে দ্বিতীয় ঘুমের সুযোগ পেতেন না ছুটির দিনেও৷ দিনান্তবেলায় তারা পুনর্বার চেঁচাতো, হয়তো বা আসন্ন নিদ্রাসুখের কথা ভেবে, হয়তো স্ব-স্বভাবে৷ সেই পক্ষীকুলের সমবেত পুরীষে সাদা হয়ে থাকত নিচের পিচরাস্তার ওই ইলেকটুকু; বর্ষার অঝোর ধারার দু’মাস বাদ দিলে মনে হতো খড়ি বাঁধানো পথ৷

বড়ো নালাতে গোদাবরিত্ব আরোপ অন্যদের কাছে ঠাট্টার বিষয় ছিল নিশ্চয়, তবে নিতান্ত অমূলক ছিল না; নালার যে দিকে বিস্তর ঝোপঝাড়, সেই দিকে ছিল বনস্পতির মত উঁচু একটা কণ্টকায়িত শিমুল গাছ, বসন্তে লালে লাল হয়ে থাকত; দুঃসময়ে অনেক পাখিকে আশ্রয় দিত, সন্দেহ নেই৷

পূব দিকের ফাটক থেকে একটা কালো পিচের রাস্তা ধা পশ্চিমে গিয়ে শেষ হতো আমাদের বাড়ি একটু পেরিয়ে, তারপর আমাদের ঝোপবেষ্টিত কানামাছি আর রুমাল চোর খেলার মাঠ, ছোট মাঠ, মাঠের উত্তর-পূর্বে দুটো করুগেটেড টিনের গেরাজ — তার একটাও আমাদের নয়, গাড়িই ছিলনা আমাদের৷ ছোট মাঠের উত্তরে বইত বৈতরণীর মত, থুড়ি … গোদাবরীর মত, সেই বড় নালা৷ বড় মাঠটা বৃক্ষে গুল্মের জংলা পাড় নিয়ে বিশাল — ওই কালো রাস্তাটার দক্ষিণ দিগন্ত জুড়ে ছোট মাঠের চৌহদ্দি পর্যন্ত — সেটা বড় ছেলেদের ফুটবল খেলার মাঠ, কাকিমা-মাসিমাদের গুঞ্জনের মাঠ, ক্বচিত কখনো বিয়েশাদি-মুখেভাত হলে প্যান্ডেল বাঁধার মাঠ৷ আর ওই যে টিনের গেরাজ, তার পাশে নির্ভরশীল সাধ্বী সতিনের মত একজোড়া বেনারসি পেয়ারা গাছ সোহাগে স্বপনে বেড়ে উঠেছিল৷ বাবা বলতেন, “বাকি ভারত যাকে আমরুদ (অমৃত) বলে, বাঙালিরা নাসপাতি-পেয়ারের সঙ্গে বাহ্যিক তফাত না করতে পেরে তাকেই বলত পেয়ারা,” তা হবেও বা! সঙ্গে ছিল ডাল-মে-কালা একটা দলছুট জামরুল৷ মোদ্দা কথা, অন্দরমহলের লালিমা সমেত পেয়ারাগুলো মিষ্টি ছিল খুব; ক্ষণজন্মা জামরুলগুলোও, দাড়ি আর কাঠপিঁপড়ে বাদ দিলে, খাসা৷ শর্করালোভী দারুপিপিলিকাদের সঙ্গে লড়াই করে গাছে উঠতাম আমরা — এ ব্যাপারে আমার বয়স্য নন্তু ছিল স্বয়ং শিবের শ্বশুরের মত দক্ষ!

শ্রীযুক্ত আইজ়্যাক মোহিনীমোহন ড্যানিয়েল ছিলেন কোম্পানির দক্ষতম রসায়নবিদ; তাঁর কথা উঠলে আজও, সেদিন থেকে ছয় দশকাধিক পরে, ইয়ং বেঙ্গল যুগের বাঙালি মহাকবির কথা মনে পড়ে, হয়ত বাইবেল ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকে ধার করা ব্যক্তিনামের যথেচ্ছ সংমিশ্রনের কল্যাণে৷ তাঁর মেয়ে, হাসি, আমার সঙ্গে পড়ত, ডাক্তার হয়েছিল পরে; ছেলে রিন্টু তখনও জন্মায়নি বোধহয়, জন্মালেও নিতান্ত ইনফ়্যান্ট; ঝন্টু তো কাকিমার মনের মাঝারে ইচ্ছা হয়েই ছিল তখন৷ বিকেল সাড়ে চারটেয় আপিস সারা হলে ড্যানিয়েলকাকা ছাতা মাথায় তাঁর প্রাত্যহিক ব্যায়াম সারতেন সেই পূর্ব-পশ্চিম দুশো গজ রাস্তায় এদিক ওদিক কয়েকবার হনহন করে হেঁটে৷ বিকেলে, কারণ সাড়ে সাত সকালে যাঁকে আপিস যেতে হয়, তাঁর পক্ষে প্রাতঃভ্রমণ দুষ্কর৷ ছাতা মাথায়, নইলে গোদাবরী তীরের যতেক বিহঙ্গ নিরস্ত্র, শিরস্ত্রাণহীন মানুষ দেখলেই চাঁদমারির মহড়া নেবে!

শ্রীযুক্ত গিও’র নামের বানান Guillot ছিল কিনা হলফ করে বলা যাবে না; সেই নাতিদীর্ঘ পৃথুল মানুষটির ছেলে, চেস্টার, আমার এলেবেলে স্কুলের সহপড়ুয়া ছিল৷ পদবির উচ্চারণটা অন্তত সঠিক৷ গিওসাহেবের মা সারা দুপুর তাঁদের ছ নম্বরের সামনের সিঁড়িতে বসে কিছু না কিছু বুনতেন: শীতকালে পশমি জামা, বাকি বছর জুড়ে লেস৷ বরিশাল-মাহিলারার শ্রীযুক্ত চিত্তরঞ্জন সেনমজুমদার কলেজে আমার পিতৃদেবের সহপাঠী ছিলেন৷ তাঁর আই.ও.কিউ.-এর আস্তানা পাঁচ নম্বরে৷ তাঁর মাতাঠাকুরানি সারা দুপুর তাঁদের সিঁড়িতে বসে ন্যাকড়ায় দেয়া বড়ি, চাটাই-কুলোর আমসত্ত আর আচারের বৈয়াম নিয়ে সতত পলায়মান রোদ্দুরের পেছনে ধাওয়া করতেন৷ (বৈধব্যসূচক কদমছাঁট পাকা মাথা; চিবুকের ওপরেও বড়োসরো আঁচিলের মধ্যে অলক্ষ্যে গজানো একটি সাদা চুল ছিল তাঁর — বিপত্তারিণীর মাদুলির চেয়ে ঢের বেশি এফ়েক্টিভ় ট্যালিসম্যান৷ চিত্তকাকার মেয়ে, পুতুলদি, সৌভাগ্যের চিহ্ন সেই নিঃসঙ্গ দাড়িটি উৎপাটন করে, জ্যামিতি বাক্সে ফুল-বেলপাতার সঙ্গে ভক্তি সহকারে ভরে, পরীক্ষা দিতে যেত৷ পরের বছর হাপইয়ার্লির আগেই আবার গজিয়ে যেত সেই মহার্ঘ্য চিকুর!) সারা দুপুর যে যার নিজের কাজ করতে করতে, সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে, স্ব-স্ব মাতৃভাষায়, অনুচ্চস্বরে অনর্গল কথা বলে যেতেন দুজনেই, যেন কত না গোপন শলাপরামর্শ করছেন, অথচ কেউ বুঝতেন না কারু কথা — শুনতেও পেতেন না বোধহয়৷

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বলুন, চাই, ইউরেশিয়ান, চারটে ফিরঙ্গ পরিবার ছিল বারো কোয়ার্টারে: ক্যাসটেলারি, ওয়ালিংটন, জোনস এবং গিও৷ আমরা আই.ও.কিউ. ছাড়বার ঢের আগে জোনসসাহেবের দেহান্ত হয়, এবং খোকাদা, সম্পর্কে আমার পিসতুতো দাদা, তাঁর খালি করে দেয়া আট নম্বরে ঢোকে৷ আট নম্বরে থাকতেই বিয়ে হয় খোকাদার, শ্রীপল্লির কালিপদদার মেয়ে কনীনার সঙ্গে (দিদিটা ভালো, আমায় ফলসা খাইয়েছিল); সে বিয়ে আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম, এবং স্বভাবতই মনে প্রশ্ন জেগেছিল “বিয়ে হল, আগুন জ্বালিয়ে যজ্ঞ হল, তবে বিয়ের সাত দিন পরেও পুত্র হল না কেন?” তা নিয়ে এত হাসাহাসির কি!

ন নম্বরে ছিল এক পঞ্জাবি পরিবার; তাঁদের ছেলে বি আমার সমবয়সী, তাও তার সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হল না; হল না, কারণ তার ছিল অদম্য যৌন কৌতুহল; আড়াল পেলেই সে গোপনাঙ্গ পরখ করে দেখতে চাইতো ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে৷

সাত নম্বরে স্বল্পকাল ছিল বেনুগোপাল-বিজয়লক্ষ্মী, তাদের পারিবারিক নাম মনে নেই তবে, অ্যালফ়াবেট ক্লাসে য়্যাফ-য়্যাল-য়্যাম শুনে, তারা যে দক্ষিণী তাতে সন্দেহ ছিল না৷ ওপাড়ায় বাংলা ও হিন্দি একেবারে বলতে বা বুঝতে পারত না একমাত্র তারাই৷

এতদিনের ব্যবধানে নিশ্চয় করে বলা মুশকিল, তবে বারো ঘরের অন্তত দশটায় আমার নিকটবয়সী ছেলেমেয়ে ছিল৷ বারো ঘর মিলিয়ে এক উঠোন না হোক, একই মাঠে খেলতে-খেলতে লড়তে-লড়তে বড় হয়েছি আমরা, বহুভাষিক মিশ্রসংস্কৃতির আবহাওয়ায়; তাই হয়ত বাড়তি সংস্কারের বোঝা থেকে শতহস্ত দূরে থাকা অপেক্ষাকৃত ভাবে সহজ হয়েছে৷

###

সেই জোনাকিরা

সুদূর শৈশবের  স্মৃতিচারণ  হুগলিভাগীরথীর  তীরে  থ়িক্সোট্রপিক  চোরাকাদায়  অসাবধানে হাঁটার সামিল — আমার সুহৃদ সুবীরের মডেল গ্লাইডার একবার খেই হারিয়ে নদীর ধারে পড়াতে গোবিন্দ ঘোষের ছেলের যা হয়েছিল…৷ তখন উদ্ধারকারীকে উদ্ধার করে কে! কোনটা যে নিখাদ স্মৃতি আর কোনটা নকল পাদপ্রদীপে আলোকিত, বোঝা মুশকিল৷ একেকটা স্মৃতি, নিজেই বুঝি, গুরুজনদের কাছে অতিশ্রবণে কচলানো পাতি লেবুর মত; কোনওটা আবার আবছা হয়ে যাওয়া পুরনো ফ়োটোগ্রাফ়ে নকল টিন্ট চড়ানো; অনেকগুলোই ছোটছোট আধ-চেনা টুকরো স্মৃতির কাট-অ্যান্ড-স্প্লাইস সংস্করণ — নির্ভরযোগ্য নয় মোটেই!

আমার জন্মক্ষেত্র ২০২-এর এজমালি ছাদে ভাঙা ট্রাইসাইকেলের চাকাসমেত অক্ষদন্ড নিয়ে কুরুক্ষেত্রে কর্ণের মত বারবেল প্র্যাকটিস মনে পড়ে প্রায় বিনা চেষ্টায়৷ আমার প্রমাতামহের শ্রীপল্লি-শান্তিনিকেতনের বাড়ির কুয়োতলায় তারস্বরে কালিন্দী নদীর কুলে গাইতে গাইতে দুলে দুলে উদোম নাচের কথাও স্পষ্ট মনে পড়ে — নৃত্যের উন্মাদনায় কে বা কারা আমার দোদুল্যমান নিষ্পাপ প্রত্যঙ্গ সকৌতুকে দেখছে, তারও খেয়াল ছিল না আমার, মনের অন্ধকার কোণে সে খেয়ালের সূচনাই হয় নি তখনও৷ তবে দুটো ঘটনারই খাকি হয়ে যাওয়া কিন্তু প্রামাণিক আলোকচিত্র মায়ের সংগ্রহে আশৈশব দেখে আসছি৷ কিছুদিন আগে পর্যন্ত এমন সব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষদর্শী গুরুজনেরা বেঁচে ছিলেন যাঁরা আজীবন সেসব কথা ভুলতে দেননি৷

আমার প্রথম বাস্তব ও স্বতন্ত্র স্মৃতি বোধহয় ওই বারো নম্বরকে ঘিরে৷ তখনও আমি মিসেস ডি’ক্রুজ়ের এলেবেলে স্কুলে ভর্তি হইনি, তখনও চার পুরোতে বেশ কয়েক মাস বাকি, ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছিল সারাদিন — পশ্চাদ্দৃষ্টিতে বুঝি ভরা বর্ষা ছিল তখন, হয়ত বা কবিকথিত মন্থর জুলাই অঙ্কের হিসেবে সেটা ১৯৫০-এর জুলাই হওয়া স্বাভাবিক৷ অবিশ্রান্ত ধারায় আমার মাঠে যাওয়া হয়নি, ডাকতেও আসেনি কেউ৷ বৃষ্টি যখন থামল তখন অস্তরবির প্রহর, স্নাত আকাশে সূর্য নেই, শুধু তার রেশটুকু আছে৷ মা তখন, অগত্যা, পেছনের বাঁধানো আঙনে ক্যাচ বল খেলার অনুমতি দিলেন৷ সে হল গিয়ে একলা ফ্যাকলা নিরুত্তেজ খেলা, মন কাড়া মত্ততা নেই তাতে৷ হয়ত এদিক ওদিক চোখ যাচ্ছিল খেলুড়েদের খোঁজে৷…

তখনই হঠাৎ চোখে পড়ে সেই রত্নমালার নাচ: অযুত-কোটি জোনাকির এক ঝাড়, যেন একটাই উজ্জ্বল নতমুখ ঝুমকো জবা, ভাস্বর এবং থরোথরো বেপথু, একেকবার জ্বল জ্বল চিতা দ্বিগুণ দ্বিগুণ  আর পরক্ষণেই নিম্নপ্রভ৷ শ্রাবণের বেখেয়ালি হাওয়ায় এদিক ওদিক দুলছিল সেই জোনাকীয় সত্তা; দুলতে দুলতে, কাঁপতে কাঁপতে, ঔজ্জ্বল্যের বিস্তার দেখাতে দেখাতে সে ছোট মাঠের পশ্চিমতম কিনারের ঝোপজঙ্গল ভেদ করে আমাদের পাছ আঙনের দিকে এগিয়ে আসছিল জুলাইয়ের মতই মন্থর গতিতে৷ তারপর বর্শা গাঁথা পাচিল ডিঙিয়ে কালোকোলো লোহার সেপাই অধ্যুষিত জলকলের মাঠে ঢুকে প্যালেস বোর্ডিঙের জংলা কিনারে স্বেচ্ছায় হারিয়ে গেল৷

সে বয়সে সেই গজগামিনীর বর্ণনা করার উপযোগী বোধ বা ভাষা ছিল না আমার, যা লিখলাম তা পরিণত বয়সের স্মৃতিচারণের ফল৷ সেটা যে আদতে ধুস্তরী মায়া বা অবোধ শিশুর রজ্জুতে অজগর ভ্রম নয়, বুকে হাত রেখে আজ আর বলা যাবে না৷ এত বছর ধরে তিল তিল  করে সঞ্চয় করা জ্ঞান, অভিজ্ঞান, শিক্ষা,  দরকচা-মারা সংস্কার ইত্যাকার উপাদানের সঙ্গে আপন মনের মাধুরী মিশায়ে  হয়ত ছবিটা ফুটে উঠেছে আজ৷ কিন্তু সত্যিই বিশাল ছিল সেই সত্তা, আমার লম্বা গোছের বাবার চেয়েও অন্তত দু হাত উঁচু, নিচের ঘেরটাও হবে ছ ফুট খানেক৷ মনে হচ্ছিল, সব মিলিয়ে সেটা জ্যান্ত, বুদ্ধিদীপ্ত, অনির্বচনীয় গেস্টাল্ট সত্তা যেন একটা, একটা বুদ্ধিমন্ত নেবিউলা যেন যোজন আলোকবর্ষের দূরত্ব থেকে নেমে এসেছে৷…

সেযুগে ফিরঙ্গদের পছন্দের মিষ্টান্ন ছিল ক্যারামেল কাস্টার্ড আর মোল্ডেড জেলি — পলসনের জিল্যাটিন পাউডারে জল-চিনি মিশিয়ে, ছাঁচে ঢেলে তৈরি — দুটোই নাড়া খেলে থরথর করে কাঁপত৷ আমাদের বাড়িতেও সেই সাগরবেলায় বহু টারেটময় বালুদুর্গের মত জেলি মোল্ড ছিল ছ’টা — তার একটা, আমার প্রথম সজ্ঞান পুরী ভ্রমণে, সেই যেবার খুকুমাসি গিয়েছিল আমাদের সঙ্গে, দুর্গ নির্মাণের জন্য বাবা সযত্নে প্যাক করেছিলেন মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও৷

সত্তাটা অন্তরালোকিত মোল্ডেড জেলির মত থরথর করে কাঁপছিল, শরীরের আলাদা আলাদা জায়গায়, গবাদি পশু যেমন ডাঁশ বসা ত্বকাংশ আলাদা করে কাঁপাতে পারে৷ একই সঙ্গে সে জেলিফিশের মত ত্রিমাত্রায় গতিশীল — সেই উজ্জ্বল জেলিফিশদের ছবি বড় হয়ে কেতাবে দেখেছিলাম, আর তাদের জঙ্গমতার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল গহন সমুদ্রের একটা অসামান্য ফরাসি ডকুমেন্টারি দেখে৷ নিজে নিজেই নিজের শরীর তারা টেনে লম্বা করে, পরক্ষণেই হ্রস্ব; সেভাবে তারা নিয়ন্ত্রণ করে স্বীয় চলন৷

সেদিনের সেই জোনাকীয় গেস্টাল্টটা বড় নালা, তার কিনারে গাবভেরেণ্ডার পাঁচ-ছ টা গাছের জটলা, আকন্দ, ধুঁধুল আর তেলাকুচো লতা, বিছুটি আর নিমঘেঁটুর ঝোপঝাড়, পাতাবাহার আর অযত্নলালিত জংলি গাছগাছড়া পেরিয়ে এগুবার সময়, পাচিল টপকে জলকলের মাঠে ঢোকার সময়, ইয়োইয়োর মত যথেচ্ছ ওপরনিচ করছিল সাবলীল ভঙ্গিতে, পারদের মত কাচ না ভিজিয়েই ত্রিমাত্রায় গড়াচ্ছিল৷ দেখেই বুঝেছি, জান বুঝকে নিজের গন্তব্যের ঠিকানা নিজেই খুঁজে নিচ্ছে! মনে হচ্ছিল অনন্তকাল ধরে দেখছি কিন্তু দু এক মিনিটের বেশি আমার দৃষ্টিপথে ছিলনা সেটা৷ পাচিল পেরিয়ে, হাঁটু সমান ঢালাই লোহার ফাঁপা ভেন্টিলেটরগুলোর স্থানু কুচকাওয়াজের ওপর দিয়ে, যেন তাদের কুশল প্রশ্ন করতে করতে, এগিয়ে চলল সেই সত্তা৷

ভেন্টিলেটরগুলো জলকলের সম্পত্তি, তাদের আমি লোহার সেপাই বলতাম — সাঁঝবেলায় তেমনই দেখাত তাদের, আবার সারা গায়ে লম্বা লম্বা ছিদ্র, মাথায় ঢালাই হেলমেট৷ আমার মনের চোখে দেখতাম, পনেরোই অগস্ট ময়দানে ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের কাতারের পিছুপিছু লোহার সেপাইদের কুচকাওয়াজ, দাপিয়ে চলেছে পতাকার দিকে মুখ ফিরিয়ে, স্থানু কনুই; ক্লাব হাউসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট নির্মল সেন মাইক হাতে বলছেন, “আজ এই পতোকার নিচে…”৷

আমিও, বক্তৃতা নয়, নিভৃত আলাপচারি করতাম তাদের সঙ্গে, তারা যে আমার জাদু জগতের সখা! তাদের পল কাটা অবয়ব দিয়ে হাওয়া বয়ে যেত — সেদিন সেই বাদলা হাওয়া নিশ্চয়ই জোরেই বইছিল অন্য দিনের চেয়ে — সানাইয়ের পোঁ ধরার মত গম্ভীর আওয়াজে৷ তখনকার অপুষ্পিত বোধশক্তিতেও মনে হয়েছিল আরও একটা বুদ্ধিদীপ্ত জাদুকরি সত্তা আমার নিজস্ব জগতের সঙ্গ চাইছে — লোহার সেপাইগুলোর মত, দক্ষিণারঞ্জনের বুদ্ধুভুতুম লালকমল নীলকমলের  মত৷  হয়ত সে  আমাকে যাচাই করতে এসেছিল সম্ভাব্য সহচর হিসেবে৷

মনে আছে, তার শরীর থেকে একটা আবছা গুঞ্জনের শব্দ আসছিল, এখন মনে হয় সজ্ঞানে মডিউলেট করা আওয়াজ: কম্পাঙ্ক আর আর আলোর মডিউলেশন, যেন সত্যিই কিছু বলছিল কোনও দুরূহ ভাষায় — সুধীন্দ্রনাথ যাকে যবনের নিবিদ  বলেছেন৷ হয়ত আমার সঙ্গে নয়, নিজের সঙ্গেই কথা বলছিল সে — এই যেমন এখন আমি কীবোর্ডে নিজের সঙ্গে কথা বলছি৷…

অনেক বছর পর একটা ট্র্যান্সফ়়র্মারের পাশে দাঁড়িয়ে আমি সে গুঞ্জন আবার শুনেছি, তবে যান্ত্রিক, তাতে ভাষাভ্রম হয়নি৷

সত্তাটা দৃষ্টিপথের বাইরে চলে যাবার পরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম আমি, ফিরে দেখার লোভে, তারপর একদৌড়ে মায়ের কাছে গিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৃশ্যটা রিলে করলাম৷ মা ভালো করে না শুনেই সহাস্যে মাথা নাড়লেন, ঠিক যেভাবে বড়রা অনেক কথা না বুঝে না শুনেই মাথা নাড়ে৷ আমার বাবাকে লোকে বলত বহুজ্ঞানী — তাঁকে পর্যন্ত আমি শোনাতে পারলাম না সেই অবাক করা জোনাকিদের কথা! অথচ, পরে যখন হেপাটাইটিসে হলুদ হয়ে শয্যাশায়ী আমি, এই বাবাই কত লুপ্ত হয়ে যাওয়া অতীত জন্তুদের (যাদের আজকের ছেলেমেয়েরা জুরাসিক পার্কের ডাইনোসর বলে জানে) কথা বলতেন৷ তাদের কেউ কেউ হাতির চেয়েও কয়েকগুণ বড় কিন্তু তৃণভোজী, কোনওটা বা হরিণের মাপের তবে হিংস্র মাংসাশী৷ বর্তমান যুগেও নাকি আছে সাগরের অগম্য গহনে দানবিক স্কুইড, অর্ণব সর্প (ফ্রিল শার্ক?), লক নেস দানব, আরও কতো সব অবিশ্বাস্য জীব৷ হাওড়া থেকে বাড়ি ফেরার সান্ধ্য ট্রেনে সদ্য কেনা একটা লাইফ় ম্যাগাজ়িনের ছবি দেখিয়ে বাবা বুঝিয়েছিলেন, দূরের নীহারিকা থেকে দলছুট একটা নাতিবৃহৎ গ্রহাণু পৃথিবীর সঙ্গে ধাক্কা খেলে, অথবা নাকি কান ঘেঁষে গেলেও, কিভাবে এক লহমায় শেষ হয়ে যাবে দুনিয়া! আমি নাকি তখন আশঙ্কায় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিলাম৷ তখন কি অবিশ্বাস করেছি সেসব আজগুবি কথা!

…হয়ত সেদিনটাই ছিল আমার নিষ্পাপ শৈশবের ইতি, চার পুরতে তখনও চার মাস বাকি, কারণ সেদিনই বুঝে নিয়েছিলাম, বড়দের যতটা সহানুভূতিশীল দেখায়, যতটা সর্বজ্ঞ, তার সিংহভাগ মেকি; বিজ্ঞ শিশুদের নিজেরটা নিজেই দেখা ভালো৷

###

ক্রমশ

                           

Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>