There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the second.
৪ জগৎ পারাবারের তীরে
কেহ বা কাহারা সেই কোন আদ্যিকালে ছোটদের শিশুনারায়ণ আখ্যা দিয়েছেন পরম ভ্রান্তিতে৷ স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ শিশু ভোলানাথ লিখেছিলেন অনুরূপ সংস্কারে৷ মথি লিখিত সুসমাচারেও হোলি ইনোসেন্টদের কথা আছে — বেথলেহেমের সেই সব হোলি নবজাতক, হেরড যাদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল; তারা রক্তের হোলি-তে রাঙ্গা বটে কিন্তু সত্যিই কি আলোচ্য অর্থে ইনোসেন্ট ছিল?
কে না জানে, শিশুদের মত জাত শয়তান বিরল — স্বয়ং হেরডও যা দুহাজার বছর আগে জানত! বাংলার ভৌতিক (চন্দ্রবিন্দুর সুবাদে নয়, প্রাচীনতর অর্থে) ঐতিহ্যে সনাস “বাঁবা, মাঁ, পাঁ বেঁতা কঁরছে, কোঁলে নাঁও,” ক-জন বাপমা হাড়ে হাড়ে প্রত্যক্ষ করেননি? যাহা চাই তাহা এক্ষুনি চাই, তর সইবে না, কেঁদে কেটে আকাশ মাথায় করবে! যে সব শিশু এতটা করে না তারা একটু ভেড়ুয়া গোছের, আমি যেমন ছিলাম৷ শিশুনারায়ণ জাতীয় বনিয়াদি ভ্রান্তির উৎস কেউ কখনও যাচাই করে দেখেছেন, নাকি তা নিয়ে গভীর গবেষণা হয়েছে কোথাও?
যাচাই না করাটাই ভারতীয় দস্তুর৷
বাপ, তস্য বাপের শ্রাদ্ধের দিন, পবিত্র নারিকেল রজ্জুতে পাঁচটি শ্বেত-লোহিত মার্জার বেঁধেছিলেন দৌরাত্ম্য থেকে বাঁচতে (মৎস্যমুখের মাছ কি মাগনা!), যমদুয়ারের দিকে যে পনস বৃক্ষ, তার ডালে৷ ব্যাস, হয়ে গেল! তাঁর সন্তানসন্ততি বিনা জিজ্ঞাসায় বংশপরম্পরায় বাপের শ্রাদ্ধে বেড়াল বাঁধবে, পাট বা শনের দড়ি চলবে না, দরকার হলে ফড়েদের কাছে চড়া দামে স্পেসিফিকেশন মাফিক বেড়াল কিনতে হবে, গুরুপুর নার্সারি থেকে টবস্থ কচি কাঁঠালগাছ ভাড়া করে উত্তরে সংস্থাপন করবেন পুরুত মশাই কিঞ্চিদধিক দক্ষিণার বিনিময়ে৷
সংস্কারগ্রস্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাতিকের মধ্যে বয়ঃপ্রাপ্ত হয় — মানবিক করুণার অত্যল্প দুধটুকু পর্যন্ত ওই দড়িবাঁধা পাঁচ বেড়ালে খেয়ে যায় — তাকে নাকি হিঁদুয়ানি বলে! কালে কালে তারা অমানুষ প্রমাণিত হলে আমরা কপাল চাপড়াই৷ যে শিশু বেড়ে উঠছে সাংসারিক কুটকাচালি, নর্দমার রাজনীতি, দুর্নীতির আবহাওয়ায়, সে কি ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে বাঁচে? ছোটরা ভালো হলে, পড়াশুনোয় খেলাধুলোয় ব্যবহারে ভালো হলে, লোকে নিরন্তর বাহবা বাহবা বললে, বড়রা মানুষ করার ক্রেডিট দাবি করেন; অন্যথায় ডিসক্রেডিটটা কি নারায়ণের?
ভেবে দেখবেন, ছোটদের পছন্দের সাহিত্য কি? কুরুক্ষেত্রে ভ্রাতৃহত্যার মহাকাব্য, পর্ণকুটির থেকে পরস্ত্রীহরণ ও রাম কর্তৃক সীতার অপমানের আখ্যান, সম্পূর্ণ স্বদেশী রাক্ষস খোক্কস, ঠাকুমার ঝুলি এবং ক্লেদাক্ত রক্তাক্ত অন্যান্য সব গল্প৷ (এখন অবশ্য দিনকাল, বিচারের মাপকাঠি, মায় পারিবারিক শিক্ষার রকম-সকম পাল্টে গেছে, পাল্টে গেছে বইগুলোও, হয়ত কমিকসের অধিকতর অনুপ্রবেশ ঘটেছে, এবং অবশ্যই দৃশ্যমান ও শ্রুতিগোচর জঙ্গম মনোরঞ্জনের; কিন্তু শিশুদের রক্তারক্তি রুচিবোধ তিলমাত্র পাল্টায়নি, তা সে মায়েরা যতই আড়াল করার চেষ্টা করুক!) সে কি নারায়ণত্বের লক্ষণ? ছোটরা যে আসলে তাবড় তাবড় মানুষের বনসাই মিনিয়েচার, বড়দের মতই তীক্ষ্ণ অথবা অল্পবুদ্ধি, বড় হতে না হতে সেটা ভুলে যান বয়ঃজ্যেষ্ঠরা৷ ছোটদের পাপ পুণ্যের বোধ কিংবা ধর্মবোধ না থাকতে পারে, কিন্তু নিজস্ব ঠিক বেঠিকের জ্ঞান টনটনে!
নানা ভাষাভাষী, বিবিধ অঞ্চলের, বারো জাতের পরিবার একত্রে বাস করলে তাদের ছেলেমেয়েরা বহুভাষিক তো হয়ই, বহুখাদকও হয়৷ আমরা বাঙালিদের পাপড়ের মত কড়া আমসত্ত, হরেক রকম বড়ি, উপাদেয় শুঁটকি মাছের বিভিন্ন দফা রান্না; দক্ষিণী মুড়ুক্কু এবং সাম্বর চাটনি সহযোগে ইডলি (দোসার নাম তখনও শুনিনি); ফিরঙ্গ সমাজের নানাবিধ দ্বিপদ চতুষ্পদ নিষিদ্ধ আমিষ — রোস্ট পাই গ্রিল স্টু কাটলেট ক্রোকে বুলি কর্ন্ড ইত্যাদি বিভিন্ন অবতারে, তৎসহ নানান মজাদার ডেজ়ার্ট; পঞ্জাবি সর্সোঁ দা সাগ এবং দেসি ঘি ভাসানো মা দি দাল; আম কুল গাজর বিট এঁচোড় রসুন লঙ্কা ওল কচুর মিশ্র উৎসের আচার এবং বিস্তর খাদ্যাখাদ্যে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম৷ সেই যে ভূমার স্বাদে রসনার শিক্ষানবিশি শুরু হলো, এখনও তার রেশ চলছে ক্রমায়ত আগ্রাসী হাঁ-হাঁ-কারে৷ নইলে প্রায়োপবাসে সাধের প্রাণটা বেঘোরে যেত; কাজের খাতিরে নিজের এবং পরের দেশে বিস্তর ঘুরতে হয়েছে তো, অখাদ্য কুখাদ্য খাওয়ার দস্তুর সেখানে, ভাত ডাল চচ্চড়ি পাব কোথায়! উপরি লাভ হলো কুনো বাঙালি হয়ে বাঁচতে হয়নি৷
চার বছর বয়স হতে না হতে আমি গুরু মেনেছিলাম চার নম্বরের বড় কাকিমার ছেলে ননতুকে, কারণ আই.ও.কিউ.তে চারদিকে ধ্রুব আর প্রহ্লাদের মত ক্ষুদে জল্লাদ, বি…র মত আগ্রাসী শিশুশত্রু বালখিল্য বাহিনী, শত্রুর কি শেষ আছে! ননতু আমাকে দুরাত্মাদের হাত থেকে রক্ষা করার আশ্বাস দিয়েছিল — না চাইতেই৷ নিজেদের বাগান থেকে বর্তুল এবং দৃশ্যত লোভন কুলে লঙ্কা তুলে এনে ভাগ করে খাইয়েছিল৷ “তোর দুটো, আমার দুটো; কুলের মত টক টক আর লঙ্কার মত ঝাল ঝাল হবে নিশ্চয়ই, বাবু বলেছে!” তার পরের ঘটনাটা আই.ও.কিউ.-এর খেলোয়াড়ি ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা — জল এবং চিনির সন্ধানে দুজন দুদিকে ধাবমান — স্প্রিন্টের সে রেকর্ড ছেলে বুড়ো ভাঙতে পারেনি কেউ৷
হেদার ক্যাস্টেলারিও ননতুর কাছে আশ্রয় চেয়েছিল: “নানটুবাবু,নানটুবাবু, বি… হমকো মারটা হায়৷” ননতু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললে, “তো হম কেয়া করেগা?” ধাক্কা খেয়ে তখন আমার সর্বজনবিদিত ডাকনাম ফিরঙ্গ জিহ্বায় বিকৃত করে সে নালিশ করত, “বাঙ্গি, বাঙ্গি, ডেকো, ডেকো, নানটুবাবু বাট নহি সুনটা!” এদিকে আমি শ্যাম রাখি, না কুলে লঙ্কা রাখি!
ক্যারল ওয়ালিংটন সে তুলনায় সাবালিকা, প্রায় হান্টারওয়ালি পর্যায়ের; বলত, “মাদার সেজ়় আই’ম আ উইচ…হোয়েন আই গ্রো আপ আই শ্যাল মেক আ টোড অভ় নানটুবাবু!” তবে এরা কেউ, যাদের নাম করিনি, সেই হাসি ড্যানিয়েল, মৃত্যুঞ্জয় মুখুজ্যে মশাইয়ের যমজ মেয়ে বড়ি-ছুটি, সেনরায় বাড়ির খোকনদা স্বপনদা, তারাও, আমার ব্যক্তিগত বাস্তব এবং গোপনতম স্বপ্নের দুনিয়াটা চিনত না৷…
আমাকে ট্যাঁকে গুঁজে অনেক জায়গায় যেতেন বাবা৷ সুনীতিবাবু, রাজশেখরবাবু এবং পুলিনমামার বাড়ি — যেখানে হয়ত অজান্তেই ভাষাজ্ঞানের উন্মেষ হয়েছিল আমার এবং সাহিত্যপ্রীতির৷ সুনীতিবাবু আমাকে আইরিশ উপকথার দেরদ্রিউয়ের গল্পাংশ শুনিয়েছিলেন; ঠিক শিশুপাঠ্য নয় গল্পটা, তবে মনে এতটাই দাগ কেটেছিল যে বড় হয়ে সে কাহিনি সংগ্রহ করে পড়ে তবে শান্তি! শিল্পী রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী বাবার প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন, একই সিটিঙে বাবা কাঠকয়লায় তাঁর৷ রমেন বাবুর একটা ভিলেজস্কেপের এচিং আমাদের বসবার ঘরে ঝুলত৷ একেকদিন আলোকচিত্রী শম্ভু সাহার সঙ্গে বাবা মেতে যেতেন প্রিনটিঙের ম্যাজিকে৷ ডোভ়র লেনে থাকতেন পরিতোষকাকা, চিত্রকর৷ মাঝে মাঝে রবিবার সকালে হাঁটতে হাঁটতে সেখানে যেতাম বাবার সঙ্গে, সুষমাপিসিদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে৷ একবার রাসবিহারীর মোড়ের উল্টোরথের মেলায় একটা লাফানে হনুমান কিনে তাঁর বাড়ি গেছি, খয়রি প্যাস্টেলের কয়েকটা আঁচড়ে পুরনো খবরের কাগজের ওপর লাফানে হনুমান সুদ্ধ আমার একটা আদল আঁকলেন; বাবা শুধোলেন, “দুটো হনুমান আঁকলি কেন?” পরে একদিন দেখি আমার সেই প্রতিকৃতির একটা বর্ধিত তৈলরঙিন সংস্করণ এগজ়িবিশনে ঝোলানো৷ আর নিয়ে গিয়েছিলেন এডোয়ার্ড স্টাইচেনের ভ্রাম্যমান ফোটোগ্রাফির প্রদর্শনী দ্য ফ়্যামিলি অভ় ম্যান দেখাতে, তাতে পথের পাঁচালি-র বিজ্ঞাপনে ব্যবহৃত স্নেহস্মিত বুয়ার ছবি ছিল, অপু ও বড়ো দুর্গা সমভিব্যাহারে৷
সেসব দেখে একটা ঝাপসা নান্দনিক বোধ তৈরি হচ্ছিল মনের গভীরে কোথাও৷
বৌবাজারে পয়োগ্রামের পালটি করা বাড়িতে সাবেকিয়ানা আর যৌথ ঐতিহ্যের একটা আলগা মাপের আন্দাজ পেয়েছিলাম৷ ধর্ম জিনিসটার মাপ পেয়েছিলাম গাঁজা পার্কের পাশে ব্রাহ্ম সম্মিলনী সমাজে — হয়তো এগারোই মাঘ, অথবা হয়তো কোনও শ্রাদ্ধবাসরে, স্মরণ নেই — এবং শান্তিনিকেতনে পৌষোৎসবের মন্দিরে প্রায় প্রতি বছর চোখ বুজে নির্জীব বসে থেকে দাদার বক্তৃতা শোনা; একবার গোরাদা(অর্ঘ্য সেন)-দের কীর্তনমুখর বাড়িতে; ভবানীপুরে জনৈক তারাপ্রসন্নবাবুর বৈঠকখানায় তাঁদের শনিবারের সান্ধ্য বৈঠকে চা তেলেভাজা সহযোগে গান শুনে৷ বাবা সেখানে মাঝে মাঝে যেতেন ওই গানের টানে৷ সগুণ নির্গুণ দয়াল ভয়াল হরির গান যে সুদর্শন ভদ্রলোক দরাজ গলায় গাইতেন, গাইতে গাইতে অকাতরে গড়িয়ে পড়ত নয়নধার, পরে শুনেছি তিনি স্ত্রীকে হত্যা করে শ্যালিকাকে বিয়ে করেন৷ আইন তাঁকে ছোঁয়নি, কারণ কর্পাস ডেলিক্টি বলে কি একটা জটিল ব্যাপারের হদিস মেলেনি কখনও৷ সত্যি মিথ্যে জানিনা তবে তাঁর কন্ঠে ভয়াল হরির অপার দয়া ছিল, সন্দেহ নেই৷
ব্যান্ডেল চার্চে মাস্ দেখেছি, গুরদোয়ারায় সৎনাম শুনে হালুয়া প্রসাদ খেয়েছি, ইফ়তার খেয়েছি বহুবার, এমন কি আইভ়্যান কিংবা ডেভ়িড ইজ়েকিয়েলের বার মিৎজ়ভ়ার নিমন্ত্রণ — তাও৷ সেই থেকেই বোধহয় — বাঁশবাগানে ডোম কানা — ধর্মে আর মতি হল না আমার! আমার চর্মচক্ষে ধর্মের যে দিকটা ধরা দিয়েছিল, সেটা হয় চোখ বুজে পিতানোঽসি শোনা, নয়তো বৌবাজারের বাড়িতে তুমুল কাঁসরঘন্টা আর ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে এত ধোঁয়া যে ভক্তি ছাড়াও আপনি নয়ন মুদে আসে, নতুবা স্ত্রীহন্তারক দুর্বৃত্তের সাশ্রুধার কীর্তন৷
অথবা হয়ত পারিপার্শ্বিকের মধ্যে একটা গোপন ছন্দ, একটা বৃহত্তর ধর্মের খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলাম, অজান্তে, খেপার পরশপাথর খুঁজে পাওয়ার মত৷
###
৫ তুঁহু মম শ্যাম
শ্যামাচরণ ছিল জাত ঠ্যাঙাড়ে, হুগলির খেঁটে-পাবড়া নিক্ষেপকারী ডাকাতদের (শরৎচন্দ্র স্মর্তব্য) সাক্ষাৎ বংশধর৷ শুনেছিলাম, আসলে সে জিরেট-বলাগড়ের লোক৷ জায়গাটা কোথায় তখন জানতাম না, কিন্তু ওই দোনলা স্থাননামের মধ্যে যে প্যানমুন্ডারি, ফার্সি (ভেবে দেখেছেন, আমরা বাংলায় বলি বেওয়ারিশ বেপরোয়া, হিন্দিভাষীরা বে-র বদলে লা দিয়ে একই কথা বলে; শব্দগুলো আসলে বহিরাগত, আরবি আর ফার্সির মিশ্রণ) আর আর্য ভাষার মিলিত রহস্য, যেমন শা’গঞ্জ-কেওটা বা ঘুরিষা-ইছাপুর, নিদেন সুতানুটি-কলকেতা, তারই মায়ায় জিরেট-বলাগড় নামটা দাগ কেটে বসে গিয়েছিল৷ কোনও একটা বিশেষ দুষ্কর্ম, হয়ত নরহত্যা করে সে গেরুয়া জটাজুট রুদ্রাক্ষ কমন্ডলু ধারণ করে অকুস্থল থেকে গা ঢাকা দিয়ে বারো কোয়ার্টারে জবরদখল আশ্রয় নিয়েছিল৷ ছদ্মবেশের অঙ্গ হিসেবে সে নাকি বেজায় দুর্বোধ্য হিন্দিতে কথাবার্তা বলছিল৷ কাজের লোকেরা আর বউ ঝিরা তো ভয়ে কাঁটা! বাবার কানে যেতে ওয়াচ অ্যান্ড ওয়ার্ডের অপেক্ষাকৃত কম ধর্মভীরু কয়েকজন শ্যামা খুনেকে ধরতে এলো৷ সেয়ানা শ্যামা বেগতিক দেখে, পরনের শেষ সুতোটা পর্যন্ত খুলে রেখে, সটান বেলগাছে, পরে যেখানে ব্যাচেলরস’ হস্টেল হয়েছিল, তার পাশে৷ সেই উচ্চাসন থেকে সে তার নিজস্ব হিন্দিতে অবিরাম গালি নিক্ষেপ করে গেল, সঙ্গে ধুপধাপ পাকা বেল৷ শেষমেশ দমকলের লোকেরা এসে জলের তোড়ে নামালো শালাকে!
মনে থাকার কথা নয়, তবু মনে আছে, কারণ হয়ত নিস্তরঙ্গ জীবনে বিশেষ কিছু ঘটত না৷
তাই বোধহয় মনে আছে ভাটির টানে কলার ভেলায় ভেসে আসা ডুরে শাড়ি পরা সেই কিশোরীটিকে, সাপে কাটা মেয়ে, যাকে তার প্রিয়জনেরা কে জানে কোথা থেকে ভাসিয়ে দিয়েছিল হুগলির জলে, যদি তার ভাগ্যে কোনও ঘুমভাঙানিয়া গুনিন থাকে ভাঁটির পথে৷ আরও মনে আছে বেনুগোপাল বিজয়লক্ষ্মীদের বিধবা আয়া গঙ্গার কথা, যে দুধওয়ালা গোবিন্দের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কাঁচরাপাড়ায় ঘর বাঁধে৷ জি.টি.রোডের ওপারে ফরাদ (ফ়িরহদ্?) আলি সাহেবের বাগানে দলছুট একটা বাঘ ধরা পড়েছিল একদা৷ প্রমাণাভাবে সার্কাস পালানো বাঘ বলা চলেনা৷ কোত্থেকে শা’গঞ্জে উপস্থিত হলো কেউ বলতে পারেনি৷ মেছো বা গুলে বাঘ নয়, খাস রাজকীয় বাঙালি! তাকে কোনওক্রমে খাঁচায় ভরে দুদিন রাখা হয়েছিল আলি সাহেবের বাগান বাড়ির হাতায়, এক আনা করে টিকিট; গঞ্জ-বেগঞ্জের অন্যান্য গাঁইয়া মানুষের মত চিত্তদার সঙ্গে ননতু আর আমি দেখতে গিয়েছিলাম৷ পরে বাঘটাকে চিড়িয়াখানায় দেয়া হয়৷ ফরাদ আলির বাগান হেজে যাবার অনেক পরেও বিলায়েৎ আলির পুকুরসহ বাগানটা টিঁকে ছিল। সেটাও জি.টি. রোডের ওপর তবে কাটোয়া রেলগেট ছাড়িয়ে কিছুটা উজিয়ে। সেখানে রোমাঞ্চকর তেমন কিছু ঘটেনি, তবে লুকিয়ে সিগারেট খাবার পক্ষে খাসা ছিল জায়গাটা!
আরেকটা ধুম্রাক্ত জায়গা ছিল কাটোয়া রেলগেটের বাঁ দিকে যে রেল কোম্পানির কালভ়ার্ট, সেটা। ধুম্রায়ণের অনেক আগে থেকেই সেখানে আমার যাওয়া আসা; কানাই শিখিয়েছিল, লাইনের ওপর একটা তামার পয়সা রেখে ঘাপটি মেরে কালভ়ার্টে বসে থাকতে। একটা দুটো চাকা তার ওপর দিয়ে গেলেই ছিটকে পড়ে যেত বিকৃতাবয়ব পয়সাটা, ট্রেন চলে গেলে একটু কষ্ট করে খুঁজতে হত পয়সাটা — ঘর্ষণে তার লালিমা ও চাকচিক্য ফিরে যেত, আকারটা শুধু অপটু হাতে বেলা রুটির মত লম্বাটে আর পাতলা।…
আমার পুরাতনতম স্মৃতিগুলো, যাদের স্বচ্ছন্দে স্বোপার্জিত স্মৃতি বলে দাবি করতে পারি, সবই বারো কোয়ার্টার কেন্দ্রিক৷ আমাদের বারো নম্বর বাড়ির ঠিক সামনের রাস্তা পেরিয়ে কয়েকটা বাহারে পাতাবাহার ছিল৷ এক উজ্জ্বল সাতসকালে তার একটার মধ্যে, দৃশ্যমান পাতার আড়ালে, সযত্নে গড়া একটি পাখির বাসা আবিস্কার করেছিলাম স্বচেষ্টায়; আমার দেখা প্রথম পাখির বাসা৷ কেউ বলে দেয় নি সেটা কি, তবু আমার চিনতে ভুল হয়নি এক চুল৷ তার মধ্যে ছিল খয়রি ছোপ ধরা তিনটে ছোট ছোট ফিকে নীল ডিম, আমার প্লাস্টিকের হাট্টিমাটিমটিমের অনবরত পাড়া ডিমের মত বর্তুল নয়, অতোটা ছোটও নয় হয়ত৷ জিজ্ঞাসু চৈতন্য আমাকে বার বার ডেকে নিয়ে যেত সেই বাসার কাছে, তবে কাউকে কখনও বলিনি তার কথা, সে আমার নিজের আবিস্কার, একান্ত আমার৷ শুধু প্রথম স্মৃতি নয়, আমার প্রথম অধিকার বোধও সেটা, সেই জোনাকিদেরও আগে৷ চোখের সামনে সেই পক্ষীযুগল পালা করে তা দিল, একদিন ডিম ফুটে বিষ্ঠা মাখা নোংরা চেহারার রোমসর্বস্ব হলুদবরণ বাচ্চাগুলো বেরিয়ে এলো, বিশ্বরূপ দেখানোর মত অসম্ভব মুখব্যাদান করে থাকত তারা, অহরহ বাপমায়ের মুখনিঃসৃত আহার্যের খোঁজে৷ চোখের সামনে তাদের বেড়ে উঠতে দেখলাম (কই, আমি তো তেমন হই হই করে বাড়িনি!), তাদের শিক্ষানবিশি উড়ান প্রচেষ্টা দেখলাম, তার পর একদিন দেখলাম শূন্য বাসা, পাখি উড়ে গেছে স্বনির্ভর হতে না হতেই৷ সেই শূন্য নীড় আমার মনের গহনে রমেন চক্রবর্তীর এচিঙের মত দাগ কেটে বসে গেল বিষাদের প্রতীক হয়ে৷ গভীরতম বোধে সেটা মৃত্যুরও প্রতীক, কারণ সেই পরিত্যক্ত গাছের নিচে সবচেয়ে কমজোরি ছানাটার শব দেখেছিলাম… তার বাপমা ভাইবোনেরা ফিরেও তাকায় নি, সেটা দস্তুর নয় বলে৷
ওই বারো কোয়ার্টারেই প্রথম মানুষেরও মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছিলাম৷…
কিছুর মধ্যে কিছু নেই, একদিন হঠাৎ কলকাতা থেকে একটা কাচে মোড়া শববাহী গাড়ি এলো মিস্টার জোনসকে নিয়ে যেতে৷ আরক্তচক্ষু, ক্রন্দনরতা মিসেস জোনসের চেহারাটা হুবহু মনে আছে আমার৷ তিনি ড্রাইভার চালিত একটা কালো গাড়িতে পেছন পেছন গেলেন, সঙ্গে মিসেস ক্যাসটেলারি ও ওয়ালিংটন৷ আরো দুএকটা গাড়ি সঙ্গে গিয়েছিল, মনে আছে৷ তবে সেই পাখির বাসাটার মত আট নম্বর খালি পড়ে রইলো না, অপেক্ষায় অপেক্ষায় অবহেলিত, ঝোড়ো হাওয়ায় ছিন্নভিন্ন হল না৷
তার অল্প দিনের মধ্যে, যাদবপুরে তাঁর নবনির্মিত বাড়িতে গৃহপ্রবেশের কিছু কাল পর, আমার দাদামশাইয়ের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হল, এখন বলে সেরিব্রাল স্ট্রোক৷…
তাঁর গৃহপ্রবেশের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে, যেন কালকের কথা৷ আমরা সকলে গৃহপ্রদক্ষিণ করছিলাম পূজাপাঠের শেষে; খুব মজা পেয়েছিলাম — যে কোনও শিশুর মত — সেই সাড়ম্বর প্রদক্ষিণে৷ আমার পছন্দ ছিল পানাপুকুরের দিকটা, যেখানে কংক্রিটের সেপটিক ট্যাঙ্কের বেসামাল ঢাকনাটা একদিকে পা দিলেই ঢেঁকির মত ঢক ঢক করছিল৷ বাপের শরীর খারাপের খবর পেয়ে মা তক্ষুনি আমাকে নিয়ে রওনা দিলেন৷ সেই যে পড়লেন দাদু, আর চোখ খোলেননি একবারও৷ পরের দিন ভোরে শুনলাম দাদু স্বর্গে গেছেন৷ সেই ধূসর সকালে দাদুর ঘরেরই বাগানমুখি একটা জানলার হাতায় গরাদ ধরে চুপটি করে দাঁড়িয়েছিলাম আমি, বুকের ভেতর একটা ফাঁকা ভাব, যেন কিছু একটা নেই, আর ফিরে পাব না কখনো৷…
দাদামশায়ের কথা বলতে গেলে দিদিমার কথা উঠবেই — দিদিমা মানে ক্ষিতিমোহনের জ্যেষ্ঠা কন্যা, রেণুকা। তিনি আমাকে বাবুসোনা বলে ডাকতেন, তাই আমিও উল্টে তাঁকে বাবু বলতাম। আমার গপ্পের ঝুড়ির বেশ কিছু গপ্পো বাবুর কাছে শোনা। ঢাকার চেয়ে শান্তিনিকেতনের সঙ্গে তাঁর গভীরতর আলাপ ছিল; অল্প বয়সেই বিয়ে হলো ‘আইতে সাল যাইতে সাল’ বরিশালে। শ্বশুরবাড়ি যেতে না যেতেই তাঁর জ্বর হয়েছে, যত্ন আত্তি করছে সে বাড়ির নতুন আত্মীয়েরা। শ্বশুর কূলের কোনও গুরুজনস্থানীয় পুরুষ রেণুকার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “ও মনি, এখন একটু ভালোবাস নি?” সেই কচি মেয়েটা কি করে জানবে যে বরিশালের বাগ্ধারায় ‘মনি’ মানে সম্বোধনসূচক dear, আর ‘বাস নি’ মানে ‘আছ কি !’ সুনীতিবাবু কি বলেছেন কোথাও, তামাম ভারত যাকে প্রেম বা প্রীত বলে, তাকে আমরা ভালবাসা বলি কেন? নরেন্দ্র দেব মশাই তাঁর স্বগৃহের নাম কি অর্থে স্থির করেছিলেন, good house অর্থে, না কি ভালো থাকা অর্থে?
মায়ের ভাষায়, দাদু আমায় আদর দিয়ে দিয়ে মাথাটি খেতেন৷ শেষ যে জন্মদিনের উপহার তিনি সহাস্যে তুলে দিয়েছিলেন আমার হাতে, বাদামি চামড়ার পাড় লাগানো একটা জলপাই রঙের ক্যানভাস স্কুল ব্যাগ, তার মধ্যে এক বাক্স ভ়ীনস্ পেন্সিল, কাঠের ফুট রুল, বড়োসরো ইরেজ়র, রানা প্রতাপ মার্কা ড্রইং খাতা, রীভ়স ক্রেয়নের লম্বা বাক্স আর বেশ কয়েকটা বই৷ তার একটা, ডরোথ়ি জনস্টনের নো-গুড, দ্য ডান্সিং ডংকি , কৈশোরতক আমার পরম প্রিয়, খাটের পাশে সযত্নে রাখা থাকত যখন ইচ্ছে পড়ার জন্য৷ আমার চেয়ে দশ বছরের ছোট ভাই সেটার দফা সারে যখন, সে তখন গল্প শোনার পোকা৷ ভাইকে দোষ দিয়ে কি লাভ; খোকাদা একবার বিলেত থেকে আমার জন্য এনেছিল একটা দম দেয়া নাচুনে গাধা, অবিকল নো-গুডের মত; তার ভেতরে কি আছে দেখতে গিয়ে আমি তার দফা রফা সেরেছিলাম কয়েক হপ্তার মধ্যে!
খাটে চিৎ হয়ে শুয়ে জোড়া-হাঁটু শুন্যে তুলে রাখতাম, ভাই আমার পেটে পা রেখে হাঁটুর উচ্চাসনে বসত৷ আমার হাতে তখন বুড়ো আংলা কিংবা কালোর বই৷ শ্যামবাজারি ঢঙে
স্–স্–স্–সনিবার তায় বৈসাখে
(তুই) ম্রেছিস আমার সেজদাকে;
সারা সিত্কাল উপুসি ভাই,
সালিক বাসায় সেঁধুলো তাই…
অবধি পড়লেই পা দিয়ে পেটে ঢুঁ মেরে বলত, “আবাল, আবাল”; তৎক্ষণাৎ আমি বলতাম, “ঢুঁ খেয়ে তো পেট ভরে না, সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে!” কিন্তু সেই নাচুনে গাধার গল্পটা বোধহয় কখনো বলিনি তাকে৷
দাদুর মৃত্যুর কিছু পরেই আমি বাড়াবাড়ি রকমের জন্ডিসে পড়ি, সাত মাস শয্যাশায়ী, বাকি বছরটা গৃহবন্দি৷ আমার মনের গহনে সেই জোনাকিরা, নষ্ট নীড়ের নিচে পড়ে থাকা সেই উড়তে না শেখা পাখির ছানা, জোনস সাহেবের অন্তিমযাত্রা, বামনদাদুর মৃত্যুপ্রশান্ত অবয়ব, আমার অসুখ ও দিনের পর দিন সেদ্ধ মেদ্ধ খেয়ে বিছানায়, এবং চিরকালের মত বারো কোয়ার্টার ছেড়ে যাওয়া অঙ্গাঙ্গী হয়ে রয়েছে৷ সে সব স্মৃতি তালগোল পাকিয়ে মনের ভেতর একটা কষ্টের প্রতীক হয়ে বেঁচে রইলো, ঢোঁক গিলতে গলা ব্যথা করা কষ্ট৷ বহু বছর পর, সম্ভবত সাতের দশকের গোড়ায়, সেই এক ঝাঁক বুক খালি করা বঞ্চনার প্রতীকের সঙ্গে জুড়ে গিয়েছিল আরেকটা: ত্রিবেনী শ্মশান ঘাটে যে দেয়ালহীন ইটের গোলাকৃতি ছাউনি আছে, তার একটা থামে শ্মশানেরই কাঠকয়লা দিয়ে লেখা ছিল, নিদয় হরি, কি নিলে!
###
৬ অরুণোদয়
সে যুগে টি.ভি. না থাকায় এবং বেসামাল কামলার কল্যাণে দারুন লাভ হয়েছিল, বিস্তর পাঠ্য অপাঠ্য বই পড়েছি, উভয় ভাষায়, ছোটদের এবং বড়দের৷ সব যে বুঝেছি তা নয়: শ্রীকান্ত প্রথম পর্ব আর দেওঘরের স্মৃতি বাদ দিলে শরৎচন্দ্রকে নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করার কি আছে, বুঝিনি কখনও, এখনও বুঝিনা৷ তবে হ্যাঁ, ভদ্রলোকের বাংলা গদ্যটা ঝকঝকে বইকি! অধিকাংশ চলিতভাষার বইয়ের সঙ্গে সাধুভাষায় দক্ষিণারঞ্জনের অনন্যসাধারণ রূপকথা, কথাসরিৎসাগর, বেতাল পঞ্চবিংশতি কিংবা রবিন হুড-এর অনুবাদ পাঠে বিঘ্ন ঘটেনি কখনো; রসগ্রহণে আগ্রহ থাকলে গোলমাল হওয়ার কথা নয়৷ শেষ তিনটে বইই, সম্ভবত, কুলদারঞ্জন রায়ের অনুবাদ, দিয়েছিলেন জনৈক প্রকাশক, পুরীতে একদা তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বাবার৷ আমার সাহিত্যরসিক ঠাকুমা দেখ না দেখ যে কোনও উপলক্ষ কল্পনা করে নিয়ে বই উপহার দিতেন৷ দাদাকে দিয়েছিলেন দু সের ওজনের বিশ্বপরিচয়; সেটা হাত থেকে পড়ে গিয়ে দাদার পায়ের বুড়োআঙুল ছেঁচে গিয়েছিল৷ অমনি আমি পক্ষপাতের অভিযোগ আনলাম, আমাকেও পা কাটা বই দিতে হবে! একটা তিন-সেরি কৃত্তিবাসী রামায়ণ পেয়েছিলাম সেযাত্রা (আদরের ফাল্গুনিকে অন্য একটা পা কাটা বই: নানা), সেটা একবার কাকে ধার দিয়ে আর ফেরত পাইনি৷ তিনি যদি এখনও বহাল তবিয়তে থাকেন, এবং তাঁর চোখে যদি দৈবাৎ এই লেখাটা পড়ে, দয়া করে ফেরত দেবেন, প্লীজ়!
কলকাতার বাড়ির খুব কাছাকাছি বেশ কয়েকটা বড়োসড়ো বইয়ের দোকান ছিল তখন৷ আমাদের ফুটপাথেই ছিল আইডিয়াল বুক স্টল আর, খুব অল্প কিছুদিনের জন্য হলেও, টবকো বলে একটা তামাক এবং বইয়ের যৌথ দোকান — বাবা সেখানে গোল টিনের তিন সন্ন্যাসিনী তামাক কিনতেন, অথবা কাঠের বাক্সে হাফ়-আ-করোনা সিগার এবং অবশ্যই কাগজ মলাটের রগরগে খুনখারাপির বই, মিকি স্পিলেন কিংবা এলারি কুইন৷ টবকো থেকে ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের পঞ্চরঙ্গ কিনেছিলাম; কিশোরপাঠ্য পাঁচটি সাবেক গল্পের সরস সংকলন, সম্ভবত অজিত গুপ্তের প্রচ্ছদ ও অলংকরণ আজও মনে আছে৷ আমার জন্ডিসের সময় কেউ টবকো থেকে কিনে এনেছিল সচিত্র বিমল দত্তের সিং খুড়োর গল্প, তার মলাট ছেঁড়া কপিটা এখনও আমার সংগ্রহে আছে৷ আদতে মৌচাকে প্রকাশিত সে গল্পসংগ্রহ আর ছাপা হয়নি কখনও; তাতেই বোঝা যায় বাঙালির পাঠরুচি কোন পথে! আইডিয়াল থেকেই সেযুগে আমার বেশির ভাগ বই কেনা; হেমেন ঘোষের বকুল পরি আর রামধনু, বিভুতিভুষণের হীরামানিক জ্বলে, সীতা দেবী শান্তা দেবীর নিরেট গুরুর কাহিনী আর হিন্দুস্থানী উপকথা, সুনির্মল বসুর হুলুস্থুল (কুকুরের তাড়া খেয়ে শেঠজি ছুটতে ছুটতে বলছেন, “প্রবাদ জানে হামি তুমি,/ কুত্তা তো আর তা জানেনা!”), বঙ্গানুবাদে ধনগোপালের চিত্রগ্রীব আর যুথপতি৷
স্মরণীয়তম হল একই দিনে আইডিয়াল থেকে কেনা সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের দুটি কবিতার বই: লাইল্যাক মলাটের কুহু ও কেকা আর চাঁপা রঙের বেনু ও বীণা৷ আজকের সমালোচকেরা সত্যেন দত্তের নাম শুনেই নাসিকা কুঞ্চন করেন৷ আমি মন্দাক্রান্তা (পিঙ্গল বিহ্বল ব্যথিত নভতল, কই গো কই মেঘ উদয় হও,/ সন্ধ্যার তন্দ্রার মুরতি ধরি মেঘ মন্দ্র মন্থর বচন কও) শিখেছিলাম তাঁর কবিতা পড়ে; বড় হয়ে মেঘদূত (কশ্চিৎ কান্তা বিরহগুরুণা স্বাধিকারপ্রমত্তঃ, কিংবা, আষাঢ়স্য প্রথমদিবসে মেঘৈর্মেদুরমম্বরম্) স্ক্যান করতে একটুও অসুবিধে হয়নি৷ বয়ঃসন্ধির ঢের আগে চার্বাক ও মঞ্জুভাষার কিশোর প্রেমের (বনপথে চলেছে চার্বাক,/ সূর্যতাপে স্পন্দিত সে বন,/ ক্লান্ত আঁখি, বিষন্ন, নির্বাক,/ বিনা কাজে ফিরিছে ভুবন) কবিতা পড়ে দস্তুরমত উপভোগ করেছি৷ আর “সব চেয়ে যে শেষে এসেছিল,/ সেই গিয়েছে সবার আগে চলে,” অপত্যশোকের সেই অসামান্য কবিতা কি সত্যিই দ্বিতীয় শ্রেণীর? পেটে পা রেখে আমার হাঁটুতে বসে ভাই …
টেঁপা টোপাটি, তুমি দোপাটি,
তোফা খোঁপাটি, বাঃ,
বাঁকানো শুঁটি বিনুনি দুটি
না হয় ঝুঁটি হাঃ!
অথবা, পিয়ানোর গান …
তুল তুল টুক টুক,
টুক টুক তুল তুল,
কোন ফুল তার তুল,
তার তুল কোন ফুল…
শুনে খুব মজা পেত৷ সেই সঙ্গে তৈরি হচ্ছিল আমার ছন্দের কান৷
কলকাতার বাড়ির উল্টোদিকের ফুটপাথে তেরচা ভাবে ত্রিকোণ পার্কের কাছাকাছি ছিল জিজ্ঞাসা; সেখান থেকে সুনীল সরকারের কালোর বই (কিন্তু ছড়া গুলো মামার) কিনেছিলাম, আর গিরীন্দ্রশেখর বসুর অনবদ্য লালকালো৷ কলেজ ছাড়ার পরে গিরীন্দ্রের ধূসর কাগজ মলাটের স্বপ্ন কিনেছিলাম লালকালোর চেয়ে একটু কম আগ্রহে; তা থেকে মনের ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলোর’ একটু আভাস পাওয়া গেল — আমার নয়, অন্যদের; আমারটা খামোখা উৎসারণ করতে যাব কেন? সুনীতিবাবুর ওরিজিন অ্যান্ড ডেভ়েলপমেন্ট অভ়় দ্য বেঙ্গলি ল্যাঙ্গুয়েজ অনেক পরে সেই পতনোন্মুখ জিজ্ঞাসাতেই কেনা৷
আমার জন্মের আগেই সিগনেট প্রেস তৈরি হয়েছে; শুনেছি, টুনটুনির বই-এর সিগনেট সংস্করণ ছাপা হয়েছিল আমাদের বাড়ি থেকে সংগৃহীত বাবা-জ্যেঠা-পিসির ছেলেবেলাকার আদি সংস্করণ অবলম্বনে, কারণ অন্য কপি চটজলদি খুঁজে পাওয়া যায়নি৷ উপেন্দ্রকিশোরের স্বহস্তে আঁকা ছবি সম্বলিত খয়রি হাফটোন মলাটের পুরনো কপিটাও আমাদের কাছে ফেরত আসে৷ লীলা মজুমদারের বেশ কয়েকটা বই সিগনেটের ছাপা: হলদে কালো চৌখুপি মলাটে দিনে দুপুরে (কেরোসিনের সুবাতাসে/ মহাপ্রাণী খইস্যা আসে,/ খাও খাও ভইরা টিন,/ কেরোসিন কেরোসিন) আর, তার বহু পরে, তাঁর বাবা প্রমদারঞ্জনের হিংস্র চোখে তাকিয়ে থাকা বাঘ মলাটের বনের খবর বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য৷ গগনেন্দ্রের ভোঁদড় বাহাদুর, অবনীন্দ্রের বুড়ো আংলা আর সবুজ মলাটে চিনে কালিতে আঁকা, শঙ্করের ছবি সুদ্ধু, বিভূতিভূষণের চাঁদের পাহাড় কি ভুলতে পারে কেউ! অধিকাংশ মলাটই সত্যজিতের আঁকা, যাঁকে ছেলেবেলায় মা এবং তাঁর শান্তিনিকেতনের বন্ধুকুল আবোল তাবোলের ছেলে বলে চিনতেন৷ এখন কেন বাংলা শিশু সাহিত্যে সেই অসামান্য নক্ষত্রপুঞ্জ চোখে পড়ে না; চোখের দোষ, না বয়সের?
আইডিয়াল বুক স্টল এখনও যথা স্থানে আছে, এবং তার অন্য পাশে বি. বড়াল অ্যান্ড সন্সের মনিহারি দোকান, যদিও চেনা মুখগুলো স্বাভাবিক নিয়মেই আর দেখি না৷ দোকানই থাকে না, মানুষ কোন ছাড়!
ঠাকুদ্দা-ঠাকুমা থাকতে আমরা কলকাতায় এলেই সকালে লুচি (বিশুদ্ধ গব্য ঘৃতে ভাজা) খেতাম: সঙ্গে হয় ছোটছোট চৌকো করে কাটা আলুভাজা, সহভর্জিত শুকনো লঙ্কার অনুপান দিয়ে; নয়তো কালোজিরে কাঁচালঙ্কা ফোড়ন দিয়ে চৌকো কাটা আলুর বাটিচচ্চড়ি, হরিদ্রাবর্জিত, নামানোর আগে একটু কাঁচা সর্ষের তেল৷ শেষোক্তটার ঘরোয়া ডাক নাম ননি তরকারি, কারণ ঠাকুমার ডাক নাম ছিল ননি৷ সোনার মত ঝকঝকে কাঁসার থালায় গরম গরম স্তুপাকার লুচির সঙ্গে কাঁসার বাটি ভরা ননি তরকারি, দারুণ, তার সঙ্গে এট্টুস চিনি দিয়ে নিলে জমে কুলফি!
সুধী পাঠক হয়তো ভাবছেন, বেশ বই পত্তরের কথা হচ্ছিল, তার মধ্যে খাবার দাবার এলো কোন লজিকে? আহা, পেটে খেলে তবেই তো পাঠ সইবে; একটু স্বাদ বদল করতে দোষ কি — তা ছাড়া কবিও বলেছেন, “জেনো সে রসের সেরা বাসা রসনায়!”
###
Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>