There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the sixth and the final.
মাস্টারমশাইদের কেউই ইহজগতে নেই আর: ফটিকচন্দ্র কুমার, শিশির সেনগুপ্ত, মীনাদি রীনাদি দুই বোন, হাসিদি, সুষমাদি, আরো কেউ কেউ বাদ গেলেন হয়ত৷ সহপাঠীদের মধ্যে এক দীপালী বাঁড়ুজ্যে ছাড়া কারু সঙ্গে যোগাযোগ নেই৷ মায়া সুরের সঙ্গে একবার পথ চলতি দেখা হয়েছিল, তাও বছর কুড়ি আগে; ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে দারুন কবিতা বলত মায়া, “কাঠবিড়ালি, কাঠবিড়ালি, পেয়ারা তুমি খাও?” মায়ার জ্যেঠামশাই, মোহিনীমোহন, ব্যান্ডেল চার্চের উল্টোদিকে সেন্ট জন’স স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন; কেহ বা কাহারা তাঁর ঘাড়ে কাটারির কোপ মেরেছিল, জব্বর কোপ, অনেক ভুগে বেঁচে গিয়েছিলেন সেযাত্রা! তাঁর স্কুলে উনিশ দিন পড়েছিলাম, হুগলি কলেজিয়েটে ভর্তির অপেক্ষায়৷
বাবার তত্ত্বাবধানে হ-য-ব-র-ল নাটক হযেছিল একবার৷ সদ্য কামলামুক্ত আমি ন্যাড়া (লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ!… সুরহীনতাটা আমার সহজাত বলে তেমন মহড়া লাগেনি), সুজিত কাক্কেশ্বর কুচকুচে (হাতে রইলো পেনসিল), সমীর ছিল প্যাঁচারক (প্যাঁচা+বিচারক), সুভাষ ব্যা-করণ শিং, বি.এ., আর ডাক্তার দাসের মেজ মেয়ে মিন্টি পুং ভূমিকায় গল্পের আমি৷ রিহার্সল প্রায়ই হত আমাদের বাড়িতে, অধিকাংশ মুখোশ কলকাতায় কেনা, শুধু কুমিরের এবং আর দু একটা বাবা নিজের হাতে বানিয়েছিলেন। সেই সুযোগে সহপাঠীদের সঙ্গে ভাবটা আরও জোরদার হলো; খালি মিন্টি, আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত, ছিল স্ট্যান্ডঅফিশ, বরং বলা ভালো তুষার কুমারী — অত রিহার্সল সত্ত্বেও আমার সঙ্গে ভাব হয়নি কখনও৷ পরে একবার রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে স্ত্রীচরিত্রবর্জিত মুকুট নাটকে রাজধরের ভূমিকায় বাপি, আমি সেজেছিলাম ইশা খাঁ, সুজিত আর শিবু অন্য দুই রাজপুত্র। সম্ভবত সেবারই পুংবর্জিত নাটক হল বিসর্জন: রঘুনাথের ভূমিকায় শিপ্রাদি, জয়সিংহ তার বোন শীলাদি আর অপর্ণা বোধহয় পিনুদি; উঠতি বয়সের ছেলেদের ভিড় হয়েছিল খুব! সেসব নাটকের রিহার্সলটাই আসল, যত দীর্ঘায়িত তত মজা!
সুজিত বল সে আমল থেকেই আমার প্রাণের বন্ধু, এখনোও তাই, তবে সে বাংলা স্কুল ছেড়ে গিয়েছিল বাঁশবেড়ে স্কুলে৷ দু দুটো হালকা হার্দিক ধাক্কা সামলে এখনও সে বহাল তবিয়তেই আছে, দেখা সাক্ষাৎ হয়৷ গীতা নন্দি আর মীনা পোড়েল — বয়েসে কিছুটা বড় তবে আমাদের সঙ্গেই পড়ত, দুজনেরই বিয়ে হয়ে যায় স্কুলের গন্ডি পেরুতে না পেরুতে৷ মীনা তার পরেই আত্মহত্যা করে: কারণটা কখনও অনুসন্ধান করিনি তবে সহজেই অনুমেয়৷ দুই কৃষ্ণার একজন, ভট্টাচার্য, ছেলে হতে গিয়ে মারা যায় কাঁচা বয়েসে; অন্য কৃষ্ণা, চক্রবর্তী, আর তার দুই ভাই, শঙ্কর (ক্লাসের একমাত্র ছেলে যে ড্রইঙের বদলে সেলাই শিখত মেয়েদের সঙ্গে) ও সমরও কোথাও হারিয়ে গেছে৷
নতুন এস্টেটে ঝোপ জলা জঙ্গলের খামতি ছিলনা, বর্ষায় জোনাকিও ছিল বিস্তর, তবু দিওয়ানা কবি হাফ়েজ়ের মত হা জোনাকি যো জোনাকি করে আমার সেই জোনাকিদের খুঁজতাম৷ সারাক্ষণ বললে মিথ্যে বলা হবে, মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে, অথবা আচমকা মনে পড়লে৷ তখনই বোঝা উচিত ছিল, কবি হওয়ার আসলি বীজ, নিষ্ঠা, আমার ভেতর নেই!
পিটর মাইকেলের পৈতৃক সাকিন ছিল বর্তমান ঝাড়খন্ডে, যত দূর শুনেছি রাঁচির অনতিদূরে বুণ্ডুর মুন্ডা বংশে তার জন্ম৷ তার জ্যেঠা ছিলেন কারখানার কর্মচারী, তখন চার্জহ্যান্ড, পরে ফ়োরম্যান৷ পিটর নিঃসন্তান জ্যেঠা-জেঠির কাছেই মানুষ এবং অমানুষ হচ্ছিল৷ এস্টেটের নবলব্ধ চুরাশি একর জঙ্গলের হাঁড়ির খবর জানত সে: কোথায় ঘুঘুদের আস্তানা (ইউ ক্যান রোস্ট দেম অন উড ফ়ায়ার… ডিলিশস্); কোথায় কুন্ডুদের পরিত্যক্ত শিব মন্দির, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করলে গুপ্তধন মিলতে পারে; কোথায় লিচু পেকেছে কিন্তু জমাওয়ালার জাল পড়েনি এখনও৷ একটা সময় আমার সঙ্গে জমেছিল খুব, বোধহয় আমার এয়ার রাইফেলের দৌলতে৷ জঙ্গলের সব খবর রাখত সে, তবে সেই জোনাকিদের নিশ্চয়ই চিনতনা, সেই উল্টোনো জবার মত, গহন সমুদ্রের উজ্জ্বল আর বেপথু জেলিফ়িশদের মত, ফিসফিস করে কথা বলা জোনাকিদের; চিনলে কি আর বলতনা আমায়? উঠতি অবস্থার জ্যেঠা জেঠি ভালো বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছিল তাকে, পিটর তাঁদের বংশে গৌরব আনবে প্রথম! কিন্তু অদৃষ্টের রসিক দেবতা আরেকবার হাসলেন: স্কুল থেকে কোথাও পিকনিকে গিয়ে সাঁতার কাটছিল সে, জলের নিচে চোরা পাথর তাকে রেয়াত করেনি৷
কানাই পিটরের চেয় বেশি জঙ্গুলে ছিল: ঈশ্বরবাগে তাদের বাড়িতে গেছি একবার, তার মা বললেন, “ঘরে নেই, দেখোগে উত্তুরের পুকুরে ডালঝাঁপ খাচ্ছে হয়ত”৷ উত্তরের পুকুর তো বুঝলাম, কিন্তু ডালঝাঁপ কি ভালো খেতে? পানিফলের মত জলে ফলে? গিয়ে দেখি, একটা গাছের ডাল পুকুরের প্রায় সমান্তরাল হয়ে ঝুঁকে রয়েছে; কানাই তাতে চড়ছে আর জলে ঝাঁপাচ্ছে৷
…আরেকবার কানাই আমায় ডিম ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ করেছিল৷ আর সব ষষ্ঠীর নাম শুনেছি, তা বলে ষষ্ঠী আর ডিম! পেঁয়াজি পেয়েছ? সেদিন সরস্বতী পুজোর ভাসান, স্কুল ছুটি৷ যথাসময়ে গিয়ে শুনি, শ্রীপঞ্চমীর পর দিন সরস্বতীর বাহনের খাতিরে ষষ্ঠী: ঘরে পোষা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, কুমড়ো সেদ্ধ দিয়ে ভাতে ভাত খেতে হয়, আমরাই খুঁজে পেতে এনেছিলাম পাত পাড়ার পদ্ম পাতা; ছেলেমেয়েদের সে সব খাইয়ে তবে মা সেই পাতে খাবে, হাতে বাঁধবে নজর এড়াবার কালো সুতো৷ সর্ষের তেল আর কাঁচা লঙ্কা চলতে পারে, পেঁয়াজ নৈব নৈব চ!
মাটির অত কাছে থেকেও কানাই সেই জোনাকিদের দেখেনি৷ বড্ড গরিব ছিল কানাইরা, পড়াশুনো চালাতে পারেনি; শুনেছি, ঈশ্বরবাগেই দোকান দিয়েছিল একটা৷
শা’গঞ্জের বাংলা স্কুলে ছটা মাত্র ক্লাস৷ কথা ছিল বছর বছর একেকটা ক্লাস বাড়বে, কিন্তু বরাদ্দ এবং স্থানাভাবে সেটা শুরুতে মেয়েদের জন্য শুধু৷ কাজে ১৯৫৭তে সপ্তম ক্লাসে উঠে শহরের স্কুলে যেতেই হল৷ একে বেপাড়ার, তায় বেড়ে ক্লাসে বেঁড়ে ছেলে! বয়েসটা একটু কম বলেই বিপত্তি বেশি; প্রতিষ্ঠা পেতে লড়াই করতে হয়েছিল রীতিমত৷ যে কথা অন্যত্র বলা হয়নি তার মধ্যে আশরফির গল্পটা জরুরি হয়ত৷ জরুরি আর কি, সে অবশ্যই — জোনাকি নয় — তবে তেমনই অধরা কিছু একটা খুঁজত৷ কলেজিয়েটের গেটের বাইরে, টিপিনের এবং ছুটির সময়, খোলা সুদ্ধ বাদাম, ছোলা ভাজা, ঝাল ছোলা, ছোলা টোপার ঝুড়ি নিয়ে বসত সে; অন্য সময় টাউন ক্লাবের মাঠে কিংবা নদীর ধারে৷
একদিন, ক্লাস সেভ়েনেই হবে কারণ সেটা ছিল ইলেকশনের বছর, ১৯৫৭, মাস্টারমশাইরা ভোটাভুটির ট্রেনিঙে গেছেন সব, হাপ ছুটি, কোম্পানির ফিরতি বাস আসতে আসতে সেই সাড়ে চারটে৷ একেকদিন দপ্তরি শুকুল চাচা লাইব্রেরিতে বসে বইপত্র ঘাঁটতে দিত হেডমাস্টারমশাই পি.কে. সেনের সস্নেহ প্রশ্রয়ে, অবশ্যই লাইব্রেরি ঘরের এক কোণে নিজের খুপরি টুকুতে অন্য কোনও কাজ থাকলে৷ না থাকলে ফাঁকা স্কুলে চড়ে খাওগে৷ সেখানে নাকি মহসিন সাহেবের কোন বিবির ভূত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, প্রবাদ অনুযায়ী নিশুত, নিঃঝুম দিনমানেও৷ একদিন কি করি কি করি করতে করতে ষাঁড়েশ্বরতলা ঘাটে বুড়ো বটের ছায়ায় গিয়ে বসেছি, দেখি আশরফি পৈঠায় ঝুড়ি নামিয়ে উদাস চোখে গঙ্গার স্রোত দেখছে, চারদিক শুনশান — জনমনিষ্যি নেই৷ সেই থেকে বুড়োর সঙ্গে আমার গলাগলি ভাব৷
আশরফির গল্পটা বহু কাল আগেই, বোধহয় কলেজে থাকতে, একবার লিখেছিলাম, তাই খুঁটিনাটি অনেকটাই মনে ছিল; যদিও সে যাত্রায় আগা এবং লেজা হীন সে লেখাটা ধোপে টেঁকে নি; কাঙ্ক্ষিত পত্রিকার সম্পাদক পত্রপাঠ বাতিল করেছিলেন, টিকিট মারা ফিরতি খাম সঙ্গে দিই নি বলে ফেরত পাঠান নি৷
মোকামায় থাকতে রুজি রোজগার ছিল না আশরফির; ওইটুকু খেতির ফসলে অতগুলো লোকের চলে! অগত্যা চাচার কাছে নৈহাটি৷ এসে দেখে, চাচার কামাই বিস্তর, তবে হারামের কামাই, ডাকা ডালনেকা পয়সা! চাচার দলেই শেষমেশ ভিড়ে গেল আশরফি, তখনই তার দেড়কুড়ি দুকুড়ি বয়েস, বাঁজা বউটা মরে বেঁচেছে৷ চাচার এক নম্বর বেওসা নৌকোয় যাত্রী পারাপার৷ রাত হোনেসে সেই নৌকো নিয়েই অভিযান: চরেরা খবর আনত; খবর বুঝে কোনও দিন এখানে, কোনও দিন সেখানে, মাসে কমসেকম দো’তিন রোজ ডাকা ডালতা থা চাচার দল৷ গেরস্ত সজাগ থাকলে বা বেগতিক বুঝলে কাজ হত না; সে সব দিন মেজাজ টঙে তুলে দারু খেত চাচা আর লাল লাল চোখে আশরফিকে গাল পাড়তো৷ ভাগের বেলায় কিন্তু অষ্টরম্ভা: কখনো সিকিটা কখনো আধুলিটা, কখনো শুধুই রক্তচক্ষু!
একা আশরফি ধরা পড়েছিল সেবার, সেই একবারই এবং শেষ বার৷ কাল বাদে পরশু যে বাড়িতে বিয়ে, গয়নাগাঁটি, নগদ টাকা, বেনারসি, কাঁসা পেতলের বাসন তো থাকবেই, বাড়ি ভর্তি কুটুমও থাকবে; সে সব জেনেই তো আসা! সচরাচর বন্দুক দেখালেই কেঁচো হয় যায় লোক, মেয়েছেলেরা চোখের জল ফেলতে ফেলতে হাহাকার করে ঠিক কিন্তু নিজের নিজের গলার হার, কানের পাশা, হাতের বালাও স্বেচ্ছায় খুলে দেয়৷ সেদিন, সেই ছোকরি, যার কাল বাদে পরশু বিয়ে, তারই গায়ে গলায় হাত দিল চাচা!
“কি সুন্দর মেয়েটা, খোকাবাবু, কি মাসুম — তোমাকে তা কি করে বোঝাই! তোমার তো বোঝার বয়েসও হয়নি; তা ছাড়া আমার দিলে যা হচ্ছিল সেটা বলবার মত ভাষা আমার নেই৷ নরম চাঁপা রঙের মেয়েটার মুখে চোখে ইজ্জতের ভয়, এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই৷ আমি বারবার চাচাকে মনা করছিলাম, হাত ধরে টেনেও ছিলাম, সেই দেখে মেয়েটা কেমন তাকিয়েছিল আমার দিকে, হয়ত আশ্বাস চাইছিল৷ কি করে ভুলি!
“মেয়েটার কোনো আত্মীয়, হয়ত ভাইয়া, চাচাকে ছাড়াবার চেষ্টা করছিল; ধস্তাধস্তিতে এমন হয়ে গেল কি খালেদের হাতের বন্দুকসে গোলি ছুটে গেল আর মরলো সেই ভাইয়া৷ মেয়েটার গায় হাত দিচ্ছে চাচা? আমার গুসসা হল৷ হতভম্ব খালেদের বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে চাচাকে ঝেড়ে দিলাম৷ সবাই দেখল কিন্তু বিচারের সময় সে কথাটা বললনা কেউ, বললে কিছু কমসম সাজা হত হয়ত! ধরা পড়লাম আমি একা, বাকি সব এ তল্লাট থেকেই পালালো, গয়নাগাঁটি নিয়ে৷
“আমার উমর কয়েদ হল৷ আঠেরো মাস রেমিশন নিয়ে সাড়ে বারো বছর খেটে বেরিয়ে এই সাত দস সাল বাদাম বেচছি৷ ভাইয়াটা তো মরেই গেল; মেয়েটা আছড়ে পড়েছিলো তার ওপর, আমি এখনো দেখতে পাই৷”
“কি দেখ, আশরফি?”
“আমি সেই মেয়েটাকে দেখি৷ বিচারের শেষ অবদি, জানি, তার বিয়ে হয়নি৷ তার পর তার কি হল? হিন্দুরা কি আর বিয়ে দিতে পারবে?…সে কোঠিতে তারা আর থাকেনা, খোকাবাবু, আমি দেখে এসেছি৷”
“তুমি কি তাকে দেখতে চাও?”
“এসব কথা বোঝার বয়েস তোমার হয়নি, খোকাবাবু৷”
আমার নিজের দিলের ভেতরকার যে আকুতি, সেই জোনাকিদের জন্য যারা দেখা দিয়ে হারিয়ে যায়, তার কথা তো আশরফি জানত না, জানার কথাও নয়, কাউকে এতদিন বলিনি সে কথা!
###
১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ ওই ১১৬ নম্বর ছিল আমাদের ঠিকানা, হাল সাকিন ও অভয়াশ্রম৷ তার মধ্যে ১৯৬২র মাঝখান থেকে ১৯৬৫র মাঝামাঝিঅবধি কাটিয়েছি কলকাতায় (যে শহরটা এখনও আমার নিজের হল না!) পড়াশুনোর অজুহাতে৷ সেই নতুন এস্টেটেই আমার যথার্থ বয়ঃপ্রাপ্তি, ছেলে থেকে লোক হয়ে ওঠার প্রথম সোপান৷ কিন্তু, সুধী পাঠক, আমি পিটর প্যানের মত চিরকিশোর থাকতে চেয়েছিলাম৷ যে ভগবানকে কখনও মানিনি, তার দিব্যি, নতুন স্কুলের বেনেবাড়ির ছেলেরা যেমন বাঁ হাত দিয়ে একবার কণ্ঠা একবার চোখ ছুঁয়ে দ্রুত লয়ে বলত, “sত্যি বলছি, মাইরি, মা কালির দিব্যি, চোক ছুঁয়ে বলছি, গণেs মানত”, সেই রকম দিব্যি গেলেও বলতে পারি, “আমি বড় হতে চাইনি, চাইনি, চাইনি!”
দীর্ঘতর সময়, হয়ত পাকাপাকি, চিরকাল, পরবাসে কাটানোর কথা ছিল, পাখির ছানা যেমন উড়তে শিখলে নিজের মনেই অন্য কোথাও চলে যায় — হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে — জীবনের বন কেটে নিজের বসত বসায়৷ আমি নিজে এবং চেনাশোনা সকলেই তাই ভাবতেন, কিন্তু অদৃষ্টের রসিক দেবতা মৃদু হাসছিলেন তখনও! আমি লায়েক হবার আগেই আমার পূজনীয় পিতৃদেব সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ফেলে সটকে পড়লেন ১৯৬৫র জুলাইতে৷ পয়সাকড়ি কিছু রেখে যাননি বলবনা, তবে এমনই তাঁর ইহলৌকিক জ্ঞান যে জীবিত কাউকে নমিনি করেননি! সেই থেকে শা’গঞ্জের ঘানিতে পাকাপাকি জুতে গেলাম৷ বিদ্যে সামান্যই, বুদ্ধি তথৈবচ, অনেকটাই পিতৃবিয়োগের আহা বেচারা সমবেদনা, বাকিটা লিখিত নির্বাচনী পরীক্ষা আর নির্দ্বিধার ইন্টারভ়িউএর খাতিরে সেই কারখানাতেই চাকরি হল একটা, তিন বছরের ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি৷
চেনা মানুষ, বিশেষ করে বাপের চেনা মানুষদের সঙ্গে কাজ করার হ্যাপা অনেক: একে তো বয়স্করা বাজে বকে বেশি, তায় পদে পদে গঠনমূলক তুলনা ও সমালোচনা!
“আর্য সেন বিরাট পন্ডিত ছিলেন, তোমার মত ফাঁকিবাজ না৷”
“এই যে তুমি ক্ষীরোদ করের চায়ের দোকানে চ্যাংড়া ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারো, এটা কি আর্য সেনের ছেলের পক্ষে শোভন?”
“তুমি শেষমেষ সত্যিই অনার্স পেয়েছিলে? সেনবাবু তোমার পরীক্ষার মধ্যেই মারা গিযেছিলেন না?”
ততদিনে আমরা ১১৬ ছেড়ে সান বারান্দাহীন ১৬৯ নম্বরে উঠে গেছি, বলা ভালো নেমে গেছি, এবং অচিরেই সেখান থেকে আরও নেমে সাবেক শা’গঞ্জ কেওটার টায়ারবাগানে, গোবিন্দ ঘোষের সন্তোষ কাসটে, কারণ বিজ্ঞপিত ইংরেজি গৃহপরিচিতির শেষ দুটো অক্ষর খসে গিয়েছিল৷ সেখান থেকে আবার লাটবাগানে, সুহাস সেনগুপ্তর নামহীন গৃহে, সন্তোষ কাসলের মত নিস্প্রদীপ নয়৷ সুহাসবাবুর এক ছেলে, সুরজিত, বাংলার ফুটবল দুনিয়ায় স্বনামধন্য, আর এক ছেলে প্রতিষ্ঠিত ভূতত্ত্ববিদ্ ও আমার সমপাঠী; সহপাঠী নয় কারণ সে পড়ত ব্র্যাঞ্চ স্কুলে৷ বহুদিন আগে জ্যোতিষ (যতীশ?) কাকা প্রায় জোর করে বাবাকে কিনিয়ে দিয়েছিলেন একটা প্রমাণসই জমি, জলের দরে, বড় রাস্তার ওপর এবং, জনধারণায়, কেওটার তখনকার রইসতম পাড়ায়, যেখানে চক্ষুবিদ নীহার মুনশির নিজের এবং তাঁর আত্মীয়বর্গের বাড়ি৷ অদূরেই ভাগীরথী সতত প্রবাহমানা, ব্যান্ডেল চার্চ চারশো গজ, স্টেশন তিন মাইলের কম, কারখানা আধ কি পৌনে মাইল!
১৯৬৮তে, এস্টেট ডিউটি দিয়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট পাওয়ার পর, বাবার মৃত্যুজনিত কারণে প্রাপ্ত ও কিঞ্চিত সঞ্চিত অর্থে একটা ভদ্রাসন তৈরি হল সেখানে, আমার পরম বন্ধু, পরে সাতাশ বছর ধরে আমার সহকর্মী, সদ্য পরলোকগত স্থপতি সুবীর সেনগুপ্তের নকশায়৷ নকশাটা অনন্য বলা যাবেনা কারণ কনট্র্যাকটর টোগু বাবু, যিনি সুবীরের সন্ধান দিয়েছিলেন, আমাদের বাড়ি তৈরির বছর দুই আগে প্রায় একই নকশার আরেকটা বাড়ি বানিয়েছিলেন চন্দননগরের পুরশ্রী কলোনিতে, সুবীরেরই ডিজ়াইনে; ট্রেনচলতি দেখা যেত এবং ডেলিপাষন্ডদের নানান আলোচনার বিষয় ছিল সেটা৷
মিল কন্ট্রোল ল্যাবের জটা গাঁজারু এবং কোকেনসেবী ছিল তো বটেই, তবে সদ্য মিক্স করা রাবার কমপাউন্ডগুলোর মনের কথা শুনতে পেত সে; মুনি বা রিওমিটার যন্ত্রে না চড়িয়েই স্পর্শে, চর্বণে, দলনে ও ঘ্রাণে সে তাদের ভিসকসিটি, অন্তত দুটো তাপমাত্রায় স্কর্চ সেফ়টি, কিওর টাইম, কিওর রেট ইত্যাদি হুবহু বাতলে দিতে পারত; বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল — কখনও জিততে পারিনি৷ পাকেচক্রে দেখা গেল, আহা উহু সমবেদনা ছাড়া আমারও একটা ঐশী ক্ষমতা আছে — জটার চেয়ে কম নয় কিছু৷ রাবার (কলচলতি ভাষায় রবাট, কারখানাটার ডাকনাম রবাট কল, আমরা সব রবাট কলের কুলি) নামক পলিমারগুলোর বিশাল অণুরা আমার কথা শুনত৷ সত্যি, প্রায় বিনা চেষ্টায়, রেসিপি দেখে বা নতুন রেসিপি উদ্ভাবন করে, স্ট্রাকচার বুঝে, প্রণিধানযোগ্য স্থাবর ও জঙ্গম প্রপার্টিগুলো অক্লেশে বলে দিতে পারতাম ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মত! হয়ত তারই জন্যে অচিরাৎ ফ্যাক্টরি টেকনিকাল ছেড়ে দ্রব্যগুণের গবেষণাগারে জায়গা হল আমার, নতুন গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে৷ অথবা, বলা ভালো, গবেষণাগারগুলোর সরকারি স্বীকৃতি এবং আর অ্যান্ড ডি-তে উত্তরণ হল যৌথ প্রচেষ্টায়, তাতে আমার দায়ভাগের (আর পাঁচ বছর ধরে মেহনতের) দাবি ছিল অনেকটা৷
গবেষণা হল গো+এষণা, গোরু খোঁজার কাজ৷ ওই রাখালিয়াপনাটা আমার সহজে আসতো, আগের জন্মে ব্রজের গোপ-বালক ছিলাম কি না কে জানে! ১৯৭৩ সাল, পশ্চিম এশিয়া সংকট এবং ওপেক সংগঠনের সব-নিংড়োনো অর্থনীতির শুরুয়াৎ৷ কাজেই আমার করে দেখানোর বিস্তর বিষয় ছিল৷ তারপর আর ফিরে দেখিনি কখনো; শুধু বিভাগের মাথা হয়ে ওঠার আগে বিদেশ থেকে একটা দুটো খেতাব আর পিঠচাপড়ানি অর্জন করতে হয়েছিল৷
অদৃষ্টের রসিক দেবতা এবার অট্টহাসি হাসলেন! নতুন মালিকদ্বয়ের আবাসিক অংশিদার তাঁর সদ্য বিশ পেরুনো ছোট ছেলের জন্য ভারতীয় কোম্পানিটা কিনে নিলেন; সহক্রেতা নাম না জানা কে এক অনাবাসী৷ বিলিতি হোল্ডিং কোম্পানির হাঁড়ির হাল, আগেই শুনেছি; এখন লীড ব্যাংকার, বার্কলে, ঋণের বোঝা লাঘব করতে গোটা কোম্পানিটা টুকরো টুকরো করে বেচে দিল, এদেশের কসাইরা যেমন করে অনায়াসে জনসমক্ষে মাংস বেচে৷ আপাদমস্তক ছাল ছাড়িয়ে হেঁটমুন্ড ঝোলানো — দাপনার দাম এত, সিনার দাম তত, এমনকি শিং সুদ্ধ মাথা আর খুর সুদ্ধ পায়ারও আলাদা দাম ধরা আছে৷ ছাল কিনবে, ছাল? ডেলা পাকানো চর্বি? সব পাবে: ইংল্যান্ড, জর্মনি, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়… মায় হিন্দুস্তান হমারা!
নতুন মালিকদের মতলব কি কে জানে!
১৮৮৮ সালে বার্মিংহাম শহরে যাত্রা শুরু করেছিল যে দিশারী প্রতিষ্ঠান, ভারতে যার নথি-ভুক্তি ১৮৯৮তে এবং শা’গঞ্জে কারখানা স্থাপন ১৯৩৬ সালে, বণিকের মুদ্রানিক্বণে তার খাসি করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি হল হঠকারিতায়! আমার ব্যক্তিগত ভাগ্য কিছুটা স্তিমিত হলেও তখনও ঊর্ধমুখী৷ তারও পরে গজকচ্ছপের লড়াই শুরু হল, দুই অংশিদারের দখলদারির পারস্পরিক লড়াই৷ অস্যার্থ, কারখানায় অশ্রুতপূর্ব সাতানব্বুই দিনের ধর্মঘট৷ পয়সার খেলা, বোঝাই যাচ্ছিল, কিন্তু কার পয়সায় দুটি ইউনিয়নই এই আত্মঘাতী খেলায় মাতল, সেটা বুঝতে সময় লেগেছে৷
এই কারখানাকে লোকে বলত মহীরূহপ্রতিম শিক্ষণ সংস্থা; ভারতময় তুল্যমূল্য অন্য প্রতিষ্ঠানে শা’গঞ্জে-কাজ-শেখা উচ্চ মার্গের লোকেদের রাজত্ব৷ সেই ভারতীয় সংস্থাও কিনা খাসি হয়ে গেল!
স্ট্রাইক মিটল, তবে আবাসিক অংশিদার পাততাড়ি গোটালো, অনাবাসী বড়-শরিকের হাতে লাগাম ছেড়ে দিয়ে৷ যাবার সময় অনেকটা রস নিংড়ে নিল আর টোপ ফেলে গোটা প্রতিষ্ঠানের বাছা বাছা লোকদের নিয়ে গেল নিজেদের প্রতিষ্ঠানে৷ আমি যাইনি; আমার কৈশোরের গোকুল, যৌবনের বৃন্দাবন ছেড়ে কোথায় যাব! …
কাতলার গাদা ইলিশের কোল
তপসে ভাজা পাবদার ঝোল…
(দখনে ছড়া)
মাছ শিকারের নেশা ছিল আগে, কিন্তু মাছেভাতে বাঙালি নই, তাই কাৎলা তপসে পাবদার খবর জানিনা৷ ইলিশটা অবশ্যই পছন্দ করি (চিংড়ি কাঁকড়াও, তবে সেগুলো মাছ নয় বলে বোধহয় ছড়ায় পাত্তা পায়নি) এবং নিশ্চিত জানি, শা’গঞ্জ ছিল প্রতিষ্ঠান কুলের ইলিশ (মনে পড়ে, ব্যান্ডেল-হাওড়া লোকালে সেই না-বাউল গায়কের টাটা–বাটা–**** বড়!) চিবিয়ে ছাতু করে ফেলা ইলিশের কাঁটার মত কোম্পানির ছিবড়েটুকু পড়ে রইলো তারপর৷ প্রতিষ্ঠান চালায় মানুষ; এক আধ জন নয়, অনেকের সমাহারে এক বিশাল মানুষের দল, সর্দার ও পুরোহিত সমেত, সতেরোর ‘ক’ থেকে উনসত্তর ‘ঙ’, যারা যন্ত্রাংশের মত নীরবে নিজের নিজের কাজ করে যায়৷ ঘড়িতে যেমন দম দেওয়া স্প্রিং, প্রতিষ্ঠানের তেমনি দম দেওয়া, জান কবুল করা মানব সম্পদ৷ নীলকণ্ঠের পালক খুঁজে পাওয়া নন্দিনীর মত অলক্ষ্য প্রেরণাও থাকে: একেক জনের একেক রকম — কারু প্রেরণা অর্থ, কারু আবার জিতবার ইচ্ছে, কেউ বা আবার জ্ঞানান্বেষী৷
সেই দম ফুরিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানে আমাকে লাথি মেরে আবার ওপরে তুলে দেওয়া হল, প্রথমে শা’গঞ্জের দন্ডমুন্ডের কর্তা, পরে কলকাতার হেড আপিসে, ক্রমক্ষীয়মান রাজত্বের একরাট রাজা!
###
১৮পূর্ণ চাঁদের মায়া
ঠিক দুক্কুরবেলা, যখন ভূতে মারে ঢেলা, চারদিক শুনশান, বাবুরা আপিসে, কাকিমা মাসিমারা নিদ্রালু, দূর থেকে শোনা যেত ডাহুকের নালিশ, প্রেমপাগল কুকুরদের ভৌভৌকার, শিলকাটা ঈশানের ডাক, সাতসতেরো পাখপাখালির হঠাৎ চেঁচামেচি৷ কর্তৃপক্ষের নিষেধ সত্ত্বেও গ্রাম থেকে ঘাসুড়েরা কাস্তে দিয়ে লনের ঘাস যেমন তেমন কেটে নিত নির্জনতার সুযোগে; যান্ত্রিক ঘাসুড়ের নিপুন ছাঁট সেই টাক পড়া শ্রীহীনতা ঢাকতে পারত না৷ লাফঝাঁপ থেকে নির্বাসিত আমি সান বারান্দায় দাঁড়াতাম এসে, হাতে হয়ত রাজকাহিনী কিংবা সিংখুড়োর গপ্পো, মনটা বাইরের বিস্তারে৷ দেখতাম, রাজ্যের কাক এসে জড়ো হচ্ছে পাশের ব্লকের ছাতে, মিটিং হবে এবার, লোকসভা বিধানসভার মত ভয়ানক চেঁচামেচি৷ বিচার হচ্ছে কোনও গুরুতর আইনভঙ্গকারী বায়সপুঙ্গবের৷ ওদের বিচারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক এবং দ্রুত; নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তক্ষুনি শাস্তি হয় অপরাধীর — ঘাতক কাকেরা সাংঘাতিক ঠোকরায় তাকে, অন্যেরা রোমান সার্কাসের হৃদয়হীন দর্শকের মত ছীছিৎকার করে আর ডানা ঝাপটিয়ে ঘাতকদের উৎসাহ দেয়৷
না-হওয়া পাচিলের ওপাশে, সবুজ হলুদ দাবাছক খেতে, পাখমারারা কি যেন বলে চেঁচায়৷…
ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো বর্গি এলো দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে? …
… জমিদারের খাজনা দেবার সময়ই কি শুধু বর্গি-বুলবুলির অজুহাত? না বোধহয়৷ এস্টেটের বাড়িতে ঢোকার সময় ইয়ংসাহেবের ঢেউখেলানো পাঁচিল সম্পূর্ণ হয়নি; সীমানার ওপারে বিস্তীর্ণ ধান খেত, মুসুর খেত, সর্ষে খেত দেখা যেত, দেখা যেত৷ সেই দিগন্তবিস্তারী সবুজ হলুদ ঢেউয়ের মাঝখানটিতে আম কাঁঠাল বাঁশঝাড় ঘেরা ছোট্ট একটা পটে আঁকা গ্রাম, ছায়াঘন, অসিত হালদারের জলরঙের মত৷ ফসলের সময় রাজ্যের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতো কোথা থেকে, তবে খাজনালোভী বুলবুলিদের দেখেছি বলে মনে পড়েনা৷ পাখমারারাও উদয় হত আকাশ ফুঁড়ে৷
বাংলায় চুয়াড় নামে একটা আদিবাসী জাত আছে, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে সাঁওতাল মুন্ডাদের সমগোত্রীয়৷ তাদেরই নামে, আমরা না ভেবে বলি, চোয়াড়ে স্বভাব, চোয়াড়ে চেহারা, চোয়াড়ে ভাষা৷ এদের এক শাখা এই পাখমারা; নামেই পরিচয় — পাখি মারা তাদের পেশা৷ দীর্ঘকাল ধরে চাষি গেরস্তদের ফসল রক্ষা করত তারা; বনবাসী রামের মিত্র গুহর মত কাঁধে ধনুক, তুনীরে তিরের বদলে কোমরে গোঁজা কেঠো মাথার ভোঁতা বাঁটুল, পিঠের ঝুলিতে জাল৷ আর থাকত ভীষণদর্শন মুখ আঁকা কেলে হাঁড়ি — নরম মাটিতে ডাল পুঁতে মাথায় চড়িয়ে দিলেই খাসা কাকতাড়ুয়া! এ ছাড়া ক্যানেস্তারা পেটানোর সরঞ্জাম৷ বাবা বলতেন ওরা নাকি যাযাবর: খেতিকাজের সময় এখানে, বছরের বাকি সময় কোথায় থাকে, কি করে, কে জানে! পাঁচিল উঠে যাবার পরে আর দেখিনি তাদের, তবে বড় হয়ে কেতাবে পড়েছি৷
গোবিন্দ নামের পাখমারাটার বছর পনেরো বয়েস, দীঘল রোগাটে শরীর, খাকি হাপপ্যান্ট আর হলুদ গেঞ্জি পরা ধূসর চেহারা৷ ট্রাইসাইকেল চালাতে দেখে ঝোপ পেরিয়ে এপারে এসে ভাব করেছিল; তার মুখটা এখনও মনে পড়ে৷ বয়েসে আমার চেয়ে বড় হলেও আমাকে ভালো লেগেছিল তার, আমারও তাকে৷ কারণ ছিল৷ আমার তাকে ভালো লাগত তার নাতিবিশাল কিন্তু অন্য দুনিয়ার গল্পের ভান্ডারের জন্য৷ সে চাইত মুখ বদল, একটু স্নেহ, একটু মনোযোগ৷ প্রথম দিনই তাকে দিয়েছিলাম আমার বরাদ্দের অস্ট্রেলিয়ান ক্রাফট চীজ়ের টুকরোটা, তার পর থেকে মঙ্ঘারামের বিশকুট কিংবা কমলালেবু আপেল৷ তাছাড়াও মা তাকে দুধ দিতেন, ঘরে তৈরি কেক দিতেন৷ জঙ্গলে পাওয়া যায় না সেসব, তাই সে আগে কখনও খায়নি৷ বলেছিল, জঙ্গলে আম জাম কাঁঠাল তো আছেই, খেত বাঁচানোর মজুরি স্বরূপ ছালা বোঝাই চাল ডাল নুন আছে, মাটির নাগরিতে জমানো তেল আছে, বন ভরা পাখি খরগোশ সজারু আছে, দিব্যি কেটে যায়৷ “ধ্যাৎ, সজারু খাস কি করে, অত কাঁটা!” সে আমার অজ্ঞতায় মজা পেত: “ছাল ছাড়ালেই সজারু তো খরগোশ, শ্যালের ভয়ে ওরা কাঁটা পরে থাকে, তাও জানিসনা!”
গোবিন্দদের ডাক পড়ত ধান বেড়ে উঠলে, তারপর কাজ ফুরুলে পাজি, যাও, চড়ে খাওগে! কাজ ফুরুলে যে পাজি হয় সে শিক্ষায় আমার সেই হাতেখড়ি; অনেক পরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি৷
আমার সেই স্নিগ্ধ, ছায়াময় আই.ও.কিউ.-এর কাছে এস্টেটের চেষ্টাকৃত শহুরেপনা ফিকে মনে হত বহুকাল৷ কালে কালে সেখানে বাস্তুর সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেল, প্রায় আকন্ঠ ভরে গেল ইয়ংসাহেবের পূর্বপরিকল্পিত সীমারেখা৷ দু দুটো ক্লাব হল — তার একটায় সুইমিং পুল, স্কোয়াশ কোর্ট, বিলিয়ার্ড ঘর৷ অন্যটায় চেনা স্পোর্টস গ্রাউন্ডের বদলে আনকোরা মাঠ৷ নতুন বাজার, লেডিজ পার্ক, তিন ভাষার তিনটে আলাদা স্কুল৷ তবে সেখানে আমার বহুকালের চেনা সেই জোনাকিদের দেখিনি কখনো, যদিও দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল সর্বদাই৷
সম্প্রতি অনেক দিন জনশূন্য ছিল সেই এস্টেট, ঋগ্বেদের হরিয়ূপীয়ার মত প্রেতপূর্ণ; সারি সারি দরজা জানালা খুঁড়ে নেয়া ফোকলা বাড়ি সব ; লুঠ হয়ে যাওয়া আলো পাখা কল৷ তবে ছিল৷ দু’একবার জি.টি. রোড দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখতে পেতাম৷ ইদানীং শুনি নতুন মালিক, হিসেব মিলিয়ে চতুর্থ পক্ষের, সেই সব ইমারত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে; অথবা হয়ত বিক্ষুব্ধ কিছু মানুষ যাদের প্রতিবাদ মানেই ভাঙচুর, গড়ে তুলতে কেউ শেখায়নি তাদের, তারাই হয়ত আগ বাড়িয়ে অতীত দর্প চূর্ণ করতে চেয়েছে এমন ভাবে যাতে আগামি দিনের কোনও রাখালদাস, কোনও মার্শাল, একটা ইটও খুঁজে না পায়৷ যাতে আবার অক্ষতযোনি কুমারী হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চলটা৷ তাকে যথেচ্ছ রমণ করতে উদ্ধত লিঙ্গের মত সারি সারি বহুতল গজিয়ে উঠবে হয়ত সর্বত্র; লোভে চকচক প্রোমোটারের চোখ, লকলকে কামাসক্ত জিভ তাদের!…
সেই জোনাকিদের কম খুঁজেছি নাকি!
ভাইয়ের যখন দশ মাস বয়েস, মায়ের শরীর সারাবার জন্য দার্জিলিং গেলাম সকলে৷ মলের এক প্রান্তে অ্যালিস হোটেলে উঠেছিলাম৷ সুধীদা, সুধীরঞ্জন দাস, সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি এবং পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য, সস্ত্রীক উঠেছেন ঠিক আমাদের পাশের কামরায়৷ অন্য কোনও কামরায় গৌরী দেবী আর গৌতম, মহানায়কের (তখনও শুধুই নায়ক) স্ত্রী ও আমার প্রায় সমবয়সী তাঁর পুত্র৷ তাঁরা এসেছেন, এবং উইন্ডামেয়ারে না উঠে অনুত্তম অ্যালিসে উঠেছেন, কারণ গৌতমের জলবসন্ত৷ স্কুল কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়েছেন একুশ দিনের মত ছেলেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে৷ সেই অন্য কোথাও, অভিভাবকদের বিচারে, কলকাতার স্বগৃহ না হয়ে দার্জিলিঙের হোটেল অ্যালিস ভ়িলা৷ সঙ্গে আছে নায়কের সেক্রেটারি, জনৈক শম্ভু৷ এসব কথা, জানাজানি হবার আগে, গৌতমই বলেছিল আমায়; তখনও তার চুমটি পড়েনি৷ অগত্যা, সুধীদার নির্দেশক্রমে এবং, আমার না হোক, আমার দশমাসের কচি ভাইটার খাতিরে, আমরা সারাদিন যথাসম্ভব বাইরে বাইরে কাটাতাম৷…
তখনও দার্জিলিং এখনকার মত ঘেয়ো, বাক্সসর্বস্ব, ঘিঞ্জি শহর নয় — খোলামেলা মল, স্টেপ-আ-সাইড দিয়ে নেমে গেলে বেহেশতের ঠিকানা৷ সারাদিনের ভাড়া করা টাট্টু নিয়ে, অথবা পদাতিক, আজ এ রাস্তা কাল ও রাস্তা চষে বেড়াতাম৷ সন্ধে বেলা ক্যাপিটলে সিনেমা, ইংরেজি ছবি থাকলে৷ জীবনানন্দের হালভাঙা নাবিকের মত, বাচ্চা নাবিক, বিদিশা শ্রাবস্তী দারুচিনি দ্বীপ দাপিয়ে বেড়াতাম সারাদিন৷ বাবা মা ভাই তখন স্যানাটোরিয়ামে শান্তিনিকেতনের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন৷…
আমার গতিপথে সরল গাছের বন ছিল অনেক, ছায়াঘন, তার ফাঁকে ফাঁকে অনেক সম্ভাবনাময় ঝোপজঙ্গল; খেলনামাপের বাঁশঝাড়; শেওলায় সবুজ পাহাড়ের গা, জ্যান্ত গাছের মাটিতে শুয়ে পড়া গুঁড়ি আর আলগা পাথর; পাহাড়ি ফুল ঝুমকোলতার মত নতমুখ ফুটে থাকত থোকায় থোকায় — সেসব বিচিত্রবর্ণ ফুলের ছবি জল রঙে আঁকলে বিশ্বাস করবে না কেউ! কথায় কথায় উড়ো মেঘ এসে ওড়নায় ঢেকে দিত তাদের অবয়ব৷
এমন জায়গায় খুব মানাত সেই জোনাকিদের, তবু কোত্থাও তাদের দেখিনি!
পুরীর সামুদ্রিক হাওয়ায় জোনাকিরা উড়ে যায়; ঘিঞ্জি গলির অন্ধকারে, হৃদয়হীন পাথরের মন্দিরে তাদের মানায় না৷
কলকাতার বড় রাস্তায় বড্ড বেশি আলো আর নিরালোক গলিঘুঁজিতে দুটো মানুষই পাশাপাশি যেতে পারেনা, কয়েক কোটি জোনাকি তো কোন ছার!
দেওঘরে জোনাকি ছিল অনেক, বম্পাস টাউনের সার সার অবহেলিত দালানকোঠার জঙ্গুলে বাগানে, পেয়ারাতলায়, অস্পৃষ্ট আতা নোনার ফলসম্ভারে, হাস্নাহানা আর যুইঁয়ের সুগন্ধী ঝোপের আড়ালে, কিন্তু বিহারী জুগনু তারা, আমার চেনা কেউ নয়৷
কোথায় খুঁজবো তাদের, কোন নিরুদ্দেশে?
শান্তিনিকেতনে তারা ইচ্ছে হয়ে ছিল মনের মাঝারে, কিন্তু গুরুপল্লি বা শ্রীপল্লিতে নয়, ছেলেবেলাতেও নয়৷ তখন চাকরি করছি কয়েক বছর৷ সুবীর, আমার স্থপতি সুহৃদ, তখন আমার সহকর্মীও৷ লাটবাগানে তার বিভাগের ভাড়া করা ফ্ল্যাট ছিল আমাদের বাড়ি থেকে দু মিনিটের হাঁটা পথ, তবু আমাদের সঙ্গেই তার থাকা নাওয়া খাওয়া৷ আমার আত্মীয়েরা, পারিবারিক ও বিবিধ বন্ধুরা, তারও খুব পরিচিত হয়ে গেছে তত দিনে৷ এক সঙ্গে দিল্লি বেড়াতে গিয়ে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছিলাম একবার, এবং তাঁদের যথেচ্ছ জ্বালিয়েছিলাম তিনজনেই (সঙ্গে টুকুও ছিল), নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে৷ অসাধারণ মেধাবী ছিল সুবীর; অধীত বিদ্যা ছাড়াও যান্ত্রিক বৈদ্যুতিক বৈদ্যুতিন কারিগরিতে; হাতে গড়া মডেল বিমানের বেতার উড়ানে; প্রাচীন, ফেলে দেওয়া, ডগলাস মোটরসাইকেল দুশো টাকায় কিনে, তিন মাসের মধ্যে স্বহস্তে সারিয়ে তুলে, স্টেটসম্যানের ভ়িন্টাজ কার প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়ার প্রকল্পে; দুনিয়ার কল্পবিজ্ঞানের গল্পে তার জুড়ি মেলা দায়৷…কারখানায় দোল হোলি মিলিয়ে দুদিন ছুটি থাকত৷ সত্তরের দশকের শুরুর দিকে একবার তার মোটরসাইকেলে (ডগলাসের চেয়ে তরুণতর অন্য এক দেশি মডেল) হঠাৎ, উঠলো বাই, তো শান্তিনিকেতন চলে গেলাম দুজন, দোলের আগের দিন বিকেলে৷ উঠলাম দাদির শ্রীপল্লির বাড়িতে, অনাহুত, কিন্তু পরম আদরে ডেকে নিয়েছিলেন দাদি তাঁর স্বভাবসুলভ স্নেহে৷
পরদিন দেখি খোল দ্বার খোল–এর মিছিলে নন্দিতা এবং দর্শকের ভূমিকায় আমার কলকাতার বন্ধুবান্ধব বেশ কয়েকজন৷ নন্দিতা আছে মানে, দেখা না গেলেও, অতীনও আছে কোথাও৷ তখনও দোলের শান্তিনিকেতনে যারা যেত তারা সম্পর্কের টানেই যেত, যেত ভালোলাগা আর পরিচয়ের নেশায়, গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মতলবি হুল্লোড় সঙ্গে বয়ে নিয়ে যেতনা৷ অমিতাদি বললেন, “মাকে এত জ্বালাস তোরা! দুপুরে তো বাড়িতে খাবি না, জানি, রাতে আমার ওখানে খাস৷” ভালোই হল, কারণ আমার সমবয়েসী চেনা স্থানীয়দের দেখা পাইনি সেবার, তাই অমিতাদির প্রস্তাবে বিনা ওজরে রাজি হয়েছিলাম৷
অবেলায় কালো করে এসেছিল আকাশ; হবি তো হ, পরিক্রমা শেষ হতে না হতে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি নামল, ফাল্গুনেই কালবৈশাখী৷ বৃষ্টি ধরতেই অতীন বলল, “চ, কোপাই দেখবি চ”৷ দল বেঁধে গিয়ে দেখি, রক্তের নদী বইছে — সে দৃশ্য আগে কখনো ঠাহর করে দেখিনি, সে ভাবে দেখার মনটাই তৈরি হয়নি হয়ত৷ সাধে কি আনন্দ বাগচী তাঁর কবিতায় আলতার শিশি ভাঙলো, কোপাই কি শান্তিনিকেতনে লিখেছিলেন! অমিতাদির বাড়ি ডিনার মানে কাঁটায় কাঁটায় আটটা, তাই ঠিক হল ছটার সময় মিলব সবাই চৈতির সামনে৷
সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে অমিতাদির বাড়ির উলটোদিকের খোয়াই, শ্রীপল্লির রাস্তার ওপাশে৷ এখন সেখানে বিস্তর দোকান, আপিসঘর, নির্জনতা কেড়ে নিয়েছে; তখন একটা বাদে আর কোনো বাড়িও ছিল না৷ কাঁকুড়ে মাটিতে গোল হয়ে বসলাম সবাই, তৃষিত মাটি তখন বৃষ্টির সব জল নিঃশেষে শুষে নিয়েছে৷ অর্জুন গলা ছেড়ে আশায় আশায় ভালবাসায়, তোমার নাকি বিয়ে হবে গাইল, আমরা হাততালি দিয়ে হাসলাম সবাই; তারপর এ কথা সে কথা, এ গান সে গানের পর নয়নিকা বলে একটি মেয়ে, আগে কখনও দেখিনি তাকে, পরেও নয়, পূর্ণ চাঁদের মায়ায় গাইল অসামান্য তৈরি গলায়৷ সে দেখতে কেমন, কি তার পরিচয়, এসব ভাবিনি৷ কন্ঠ দিয়ে সে একটা মায়ার জাল, পূর্ণ চাঁদের মায়ার জাল, বুনেছিল — যে চাঁদটা তখন স্নাত আকাশে একটা সরল প্রতীকের মত জ্বলজ্বল করছে; যে চাঁদ পূর্ণ হলেও আশৈশব আমি বলতাম পুরনো চাঁদ, চির চেনা, তবু নতুন চাঁদ, ফি-পূর্নিমায় নতুন করে ওঠে, জলে ধোয়া বসন্ত পূর্নিমায় আরো নতুন যেন! কোপাই তখন অনেক দূরে, দৃষ্টির আড়ালে, কিন্তু কল্পনায় তার রাঙা জলের ছলাৎছল শুনতে পাচ্ছিলাম৷ সেই মায়া, চাঁদের আলো আর সুরের মূর্চ্ছনা মাখা সন্ধ্যায় আসা উচিত ছিল তাদের, তবু সেই জোনাকিরা আসেনি৷
###
সেই যে ছড়া আছে না,
এক পয়সার তৈল
কিসে খরচ হইল?
তোর দাড়ি, মোর পায়ে
আরো দিছি ছেলের গায়ে।
ছেলেমেয়ের বিয়া হলো,
সাত রাত্তির গাওনা হলো।
কোন আবাগি ঘরে এলো
বাকি তেলটুক ঢেলে নিল?
… জীবনের বারো-চোদ্দ আনা খরচ করে ফেলে আজ আমি বাকি তেল টুকুর খোঁজ করছি! তেল তো তরল: উবে যায়, গড়িয়ে যায়, দাহ্য বলে পুড়েও যায়। নসিবের বা বহিরাগত আবাগিদের দোষ দিয়ে লাভ কি! তাছাড়া নসিব যেন গনৎকারের ধামাধরা!
আরও একটা আপ্তবাক্য আমাকে বিষম ধন্ধে ফেলে। চিত্তকাকার ছেলেবেলায় দেখা এক বরিশাইল্যা পাগল নাকি অন্যদের একটু বেচাল দেখলে বলত, “যত সব পাগলের বাসা, কলা খায় ছুইল্যা!” (চ-বর্গের পূর্বী ঢঙের দন্ত্য উচ্চারণ আর মহাপ্রাণের গিলে ফেলা হ বাংলা লিপিতে ফোটানো শ্রমসাপেক্ষ; কাজটা পাঠকের মর্জির ওপর ছাড়া রইলো।) আমিও দেখি, চারদিকের বিষয়ী সংসারী সফল যত মানুষ গোমড়ামুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কলাও খাচ্ছে ছুলে! তারা পাগল নয়তো কি?
হয়ত এককালে তাদের কেউ কেউ আমার খেলুড়ে ছিল, ছেলেবেলাটা বেদম হাসি আর পরিমিত কান্নার মধ্যে বড় হয়েছি সব, হয়ত অজান্তেই ভেবেছি তেমনি করেই দিন যাবে। আমি চেষ্টা করে হাসিটুকু বাঁচিয়ে রেখেছি, ঠিক; আমার সহখেলুড়েরা অনেকেই দরকারের চেয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে — এতটাই গম্ভীর যে আরেকটু হলেই বিবর্তনের পথে পিছু হঠতে হঠতে গোরিলা পর্যায়ে পৌঁছে যেত। তাদের কেউ কেউ ধর্ম খুঁজে পেয়েছে কেউবা অধর্ম; ভাগ্যগণনা রত্নধারণ পূজাপাঠ ইত্যাদিতে অগাধ বিশ্বাস তাদের। দুয়েকজনকে প্রশ্ন করে দেখেছি; তারা সোজাসুজি উত্তর দেয়নি তবে শরীরী ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রশ্নটা তাদের মনঃপুত নয়। আবার সেই চিত্তকাকা কথিত একটা মাহিলারার রোম্যান্টিক যাত্রার ডায়ালগের মত: নায়ক জিজ্ঞেস করলো, “জানালার পাশে একাকী বসি কি ভাবিছ রাজবালা?” নায়িকার ভঙ্গিমুখর উত্তর, “মরি এ কোন জ্বালা, এ কোন জ্বালা!”
সে যাকগে, আমি তো কলাই খাইনা, তার ছোলা না আছোলা! অর্থাৎ আমাকে পাগল প্রতিপন্ন করা শক্ত হবে।…
আগে এক সময়ে অ্যাভ়রো ৭৪৮ বিমানের অনেক উড়ান ছিল দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে, লাফানে উড়ান, দুই বা তিন লাফে গন্তব্যে পৌঁছোত৷ তেমনই একটা উড়ানে মাদ্রাজ থেকে ব্যাঙ্গালোর কিংবা কোচিন যাচ্ছি একবার — সম্ভবত তিরুপতি ছুঁয়ে৷ তড়িঘড়ি উঠেছি বলে নম্বরহীন আসনমালার ডানদিকের শেষ লাইনে জানালার সীট পেয়ে গেছি, অন্যটা খালি৷ ব্রীফ়কেসটা রেখেছি সেখানে৷ সে বয়েসে অবশ্যই আশা করতাম কোনও সুন্দরী সেই খালি আসনটা দখল করবেন হয়ত, কিন্তু মধ্যপথে উঠলেন এক দক্ষিণী ভদ্রলোক, মাঝবয়সী; আমাকেও বিরক্তিভরে বাক্স কোলে নিতে হল৷ বিমান ছাড়তে না ছাড়তে ভাব জমাতে শুরু করলেন৷
তিনি নাকি দেবরাজ অর্সের পোষা গণৎকার এবং, তাঁর গণনায়, অর্স অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী হবেন অদূর ভবিষ্যতে! আমার কার্ড চাইলেন৷ তারপর শুরু হল আমার নামের অক্ষরগুলো দিয়ে নিউমেরোলজির ব্যাখ্যান৷ সাতকেলে অবিশ্বাসী সেই আমাকেই শোনাচ্ছে ভূত ভবিষ্যতের সাতকাহন! অতীতের দশটা কথা বললে, কে না জানে, চার পাঁচটা মিলবেই৷ “তোমার জীবনে একটা বড় আঘাত এসেছিল কৈশোরে”…পিতৃবিয়োগ, এটা কাকতালীয় কিন্তু সত্যি৷ “অল্প বয়েসে খুব বড় চাকরি কর তুমি”…আমার কার্ডেই তার হদিস৷ কিছুর মধ্যে কিছু নেই, হঠাৎ বললেন, “আরো বড় আঘাতের জন্য তৈরি থেকো, পঞ্চাশের কাছাকাছি, প্লাস মাইনাস তিন!” এটা মোক্ষম এবং মজাদার ভবিষ্যৎবাণী, তায় আবার হবু প্রধানমন্ত্রীর খোদ গণকের মুখনিঃসৃত, স্বকর্ণে শুনেছি বলেই — এবং অর্স যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হননি — মনে ছিল৷ হাড়ে হাড়ে তার যাথার্থ্য টের পেয়েছি অনেক পরে ৷
জটিল রাবারের অণু বিস্তর ঘেঁটেছি; দরকার মত নির্দ্বিধায় ম্যানিপুলেট করা যেত তাদের, রামের সঙ্গে রহিমের ভাগ্য মিলিয়ে দিয়ে অচিন্ত্য নতুন গুণাবলী আরোপ করেছি অনায়াসে৷ মানুষ জাতটা রাবারের অণুর চেয়ে, আগেই জানতাম, অনেক অনেক বেশি জটিল, তবে অঙ্কের না হোক সমাজতত্ত্বের নিয়ম তো মানে! কিন্তু কর্মীদের যারা অঙ্গুলিহেলনে চালায়, সেই মালিকপক্ষ ও তার সাক্ষাৎ প্রতিনিধিরা, এই অধমও যার বাইরে নই, তারা সেই পাঁচ হাজার মানুষের চেয়েও বেশি জটিল, ডি.এন.এ.’র জোড়া ইশক্রুপের প্যাঁচের ওপর কয়েক গুণ! চড়াইয়ের রাস্তায় শত্রুর সংখ্যা বাড়ে, তাও জানতাম৷ যাদের উপকার করেছি তারাই যে বেশি শত্রু হয় তাও, বিদ্যেসাগর মশায়ের দৌলতে, অজানা নয়৷ তবে চেনা মানুষ, কাছের মানুষও যে কোথায় নামতে পারে তা বুঝিনি মোটেই৷ নিউমেরোলজিস্টের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু ১৯৯৩এর শেষের দিকে, যখন আমার বয়েস সাতচল্লিশ, বিরোধীদের চাপে এবং বৃহত্তর দায়িত্বের নামে, নবকলেবর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ — রণাঙ্গনে যাঁদের দেখা দায় কিন্তু হোমারের গ্রীক দেবতাদের মত মরণশীল মানুষের বাঁচামরা যাঁদের হাতে — রাতারাতি কলকাতায় বদলি করলেন আমায়, নেইসাম্রাজ্যের এক্কা গাড়ির ঠুলি আঁটা ঘোড়াটার ভূমিকায়৷ হেড আপিসে ঠাইঁ হল একতলার টয়লেটের পাশের ঘরটায়, যেটা আগে ছিল কোম্পানি সেক্রেটারির কাগজপত্রের গুদাম৷ সেখান থেকে অবশ্য বাহুবলে সর্বোচ্চ তলার একটা ঘর দখল করেছিলাম আবার৷ সেসব ব্যাখ্যান নয়, আঘাতের ব্যাপারটা বোঝানো দরকার এখানে৷
সেই জোনাকিদের থেকে বহু দুরের একটা হাঁপিয়ে ওঠা, রং চটা, যক্ষাগ্রস্ত শহরে নির্বাসন আমার মত লোকের কাছে দ্বীপান্তরের চেয়েও বৃহত্তর আঘাত৷ ১৯৯৪-এর শেষের দিকে মুক্তির দরখাস্ত দিলাম, ১৯৯৫এর ফেব্রুয়ারিতে একতৃতীয়াংশ বেতনে যোগ দিলাম অন্যত্র৷ তারপর আর কারখানার চৌহদ্দির ছায়া মাড়াইনি কখনো৷
যতই নির্লিপ্ত হই, খেদ থেকে যায়৷
পঞ্চিপিসির খোঁজ করিনি আর৷ আমার এলেবেলে স্কুলের এক সুন্দরী, বড় হয়ে বিমান বালিকা হয়েছিল; একটা উড়ানে তার ফোন নম্বর দিয়েছিল পুরনো দিনের খাতিরে৷ যোগাযোগ করিনি৷ সুভাষ কুলকার্নির সঙ্গেও আলাপটা ঝালাইনি৷ সে সবই আমার দোষ, মানি৷ চুয়াড় জাতির প্রতিভূ, গোবিন্দ, সেই এক ফসলের পর আর আসেনি৷ ঘরে তৈরি রাজাভোগ, পান্তুগোল্লা খাবার নিমন্ত্রণ করে ফটিকবাবু চিরকালের জন্য চলে গেলেন৷ আলতার শিশি ভাঙা খোয়াইয়ের পূর্ণিমায় নয়নিকা আর কোনও দিন গান শোনালোনা৷ সুবীরের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয়েছিল ইদানীং — সেটা দেখাসাক্ষাতে পরিণত হওয়ার আগেই সে তড়িঘড়ি চলে গেল নিরুদ্দেশে, তর সইলনা৷ সেই জোনাকিরা যে ফিরে এলোনা আর, সেসবও কি আমার দোষ?
আসলে সারা বেলা হেলা ফেলা দেখে কোন আবাগি যেন আমার অজান্তেই বাকি তেলটুকু ঢেলে নিয়ে গেছে; ভারি তো এক পয়সার তৈল!
—শেষ—
Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>