The lugubrious clearing in the mango orchard

4 08 2019

In the small town of Sahaganj, a fairy tale land, there were several intensely green areas, apart from paddy lands, remnants of its past sylvan glory. The town was once depopulated by a sapping epidemic– Burdwan fever– also called the malaria. Misquitos were held responsible. but it was more likeltly to be the doing of Fate. For the next time around, after a brief period of glory, the town itself had vanished into a never never land, bricks,buildings,edifices and all.Just a few people remembered a wee bit of its glory– they too were on the vanishing path.

Much of it was merely a paddy ground in its previous incarnation, dotted with several mango groves. thy were usually impassable for the thorny undergrowth. At least one had a non- thorny clearing. that was where myself along with Peter Michael got lost for several hours one monsoon afternoon.

After the first shock of getting lost, i fell inlove with the magical clearing if and when I could find it. Its magic made it hard to find.

My father was the well-known Daubrahma Bachaspati, who ran a chatuspathi school in Bangshabati. My mother breathed her last in complications of childbirth before she could breast-feed me. Father named me SarasvatI after the river that merged into the sangam, and brought me up as a worshiper of the goddess SarawvatI. I went to his school, where I was the only girl. In those days, the SarasvatI river in these parts was mightier. It had enabled a healthy trade- international on its shore. The business centre was called Saptagram and our village was part of it. All sorts of people could be seen in the region. Normal, very fair very dark, yellow. And they spoke all sorts of tongues. The trade was brisk and our people earned gold in exchange of terracotta figures and images, coarse cotton textiles, fine textiles from Dhaka. That Saptagram boasted of some fifty chatushpathIs was also because of foreign traders. They needed to learn our languages and arithmetic. My father’s toll was no exception, for along with Samskrita and Ardha Magadhi, he also taught saurasenI of the western seaboard.

Sohrab was the son of a tycoon from the other side of the western sea. Their business was all-embracing and far-reaching. He put Sohrab in father’s school for some ulterior motive of far-reaching design.And we fell in love with each other. Everyone agreed that I was beautiful, though I didn’t see it myself when I looked at my image in the brass plate filled to the shallow brim with water.

This hide-out was Sohrab’s discovery. His father used to buy fresh mangos from around here for export. In his quest to cut down all middlemen, he began to engage his own appointee to lease orchards. This was one of his. The caretakers would build a bamboo platform in the clearing to sleep on and they guarded the fruits from errant stealers. Sohrab liked the look of this one and requisitioned it for his personal use. It was a beautiful place. Sunlight reached down to the ground refracted through the many layers of foliage’s. Everything was faintly green, without any glare. We could hear the bird’s chirps but nothing else. No one could see us from the outside. It was an ideal lovers’ tryst. The merchants from abroad also had different religions. Sorab’s religion was different. That didn’t matter to either of us.

yes, we had seen many religions: those who worshipped the adideva, the Krishna Vasudeva, the Krishna Gopi, Shakti in her many forms, and Buddha’s and Jina’s religions.

In the recent past one more religion, Islam, had entered our land. So many faiths in one place are bound to create animosity and confusion. But in my lifetime, it wasn’t so.

Adolescents anywhere would fall in love, whatever their creeds are, and they need some privacy to talk to each other and kiss each other. That’s why trysts are important. But the trouble was that Dayananda Mukhopadhyawho ran another chatushpathI nearby also had a son, Neeleshvar who was a staunch Saivite and had glad eyes for me, though. He lacked the courage to say so. He had us followed to the tryst and one afternoon,when I was waiting there alone for Sohrab, trespassed and violated me., not alone but along with his cohorts. I was outraged but defenceless. Later when Sohrab arrived, he found my bleeding dead body on the bamboo platform. I was staring vacantly at the sky– rather the green aura that filtered through the foliage’s. He had no idea who did it, but shattered he was. Only the week beforehand told me that he wished to become a ratnabanik, a gem merchant. He wanted to export rubies from Brahmadesh to the world market and settle in a faraway land. Now his dream and my life were gone.

For well-nigh 300 years, I had been waiting for Sohrab’s ministrations, but not to any avail. The bamboo platform rotted away some undergrowths crept up but still no reptiles, no scorpions dared to infest the hallowed clearing. It grew gloomier and gloomier by the day, this lugubrious green-tinted clearing was lonelier than ever, till one day I saw two boys entering it for shelter against rain.no, they weren’t Sohrab or Neeleshvar but two unrelated alien kids of about the same age.They couldn’t help me any.





আমার স্কাউটিং জীবন

30 07 2019

স্কাউটিং শব্দটির মানে হল পূর্বানুসন্ধান।Talenr acoutরা প্রতিভার খঁোজ করে। বেডেন পাওয়েল অবশ্য ঐ নামে মুক্তাকাশে ছোটদের চরিত্রবিকাশের একটি সৈনিকবৃত্তির আন্দোলন শুরু করেছিলেন। আজ দ্বিতীয়টির সঙ্গে আমার সম্পর্কের কিছু কথা বলব। শা’গন্জে বারো কোযার্টারের পেছনে জলকলের মাঠ, প্রথমে সেখানে ছিল স্কাউট্স ডেন। জ্যেঠামশাই (মৃত্যুন্জয় মুখার্জি ছিলেন তার প্রধান কর্ণধার, সঙ্গে ফণিিদা (ফণি চক্রবর্তী)। পরে, নতুন এস্টেটতৈরিহতে স্কাউট্স ডেন সেখানে উঠে যায়।সেটাও আমাদের নতুন বাড়ির পিছনে।সোভিয়েত রাশিয়াতে অনুরূপ আন্দোলন পাইওনিয়ার্স বলে পরিচিত ছিল।

আমার জানা স্কাউট্স আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ছিল,শেয়ালের বাচ্চা সেজে, “আকেলা, উই’ল ডু আওযার বেস্ট” ড্রিল কিংবা “মূগলীর শিকারী” গান “অনুশীলন করা।তার সংগে লেফট রাইট কুচকাওয়াওজ।আকেলা মানে একলা নয কিন্ত, অনেকে মিলে। ইউনিফর্ম আর ওয়গ্ল দিয়ে স্কার্ফ পরতে কিন্তু দারুন লাগত।পরে দেখলাম এখানেও পডাশুনো আর প্রোমোশনের ব্যাপার আছে। কাব থেকে স্কাউট্, স্কাউট্ থেকে রোভার, সেখান থেকে স্কাউটমাস্টার হতে গেলে সেই সব ধাপ পেরুতে হয় একে একে।

আমার কখনোই ঠিক পাইওনিযারিং প্রবৃত্তি ছিল না। তাই দীর্ঘকাল সম্পৃক্ত থেকেও ভাল স্কাউট্ হতে পারিনি।তবে তিনটে ক্যাম্প করার সুযোগ হয়েছিল।প্রথমটা ছিল ডানলপ বাঙলা স্কুলের নতুন বাড়িতে। সে বাড়িতে আমি কখনও পডিনি, তাই সেটা আমার স্কুল বলা যাবে না। সেটা স্কাউট্স ডেনের পূবদিকের জঙ্গল পেরিয়ে হাসপাতালের দিকে। স্টাফ কোযার্টারের প্রথম বাডিটায় ইন্দু দিদিমনি থাকতেন, ইন্দুমতী নিয়োগি। তাঁর ছেলে চন্দদা, মেয়ে কুমকুমদি। এঁরা কেউ স্কাউটিঙের লোক নন।

স্কুলে ক্যাম্প করার সুবিধে অনেক, তাঁবু খাটানো বা ল্যাট্রিন ট্রেন্চ খুঁড়তে হয় না। তবে অসুবিধে বিস্তরঃ যথা প্রাতঃকৃত্যাদির জায়গাগুলো ক্লগ্ড হয়ে মশাদের আক্রমণ ইত্যাদি। একবার মনে আছে রেতের বেলা হিসি করতে উঠে (না বাথরূমে যাইনি, বারান্দার ইট-সিমেন্টের রেলিং বেশি উঁচু ছিল না তো) দেখি গেন্জি আর হাপ প্যান্ট পরা এক বেহ্মোদত্যি, তার মাথাটা আকাশে ঠেকেছে,মুখাগ্নি দ্বখে বুঝলাম সিগারেট খাচ্ছে। হঠাত বড় বড় চেক ওয়ালা লুংগি পরা রোমশ খালি গা আরেকটা ভূতো এল, একই রকম আকাশ ছোঁয়া মাথা। ঠাহর করে দেখি, এতো শ্যামলদা আর সাধন দা, ওদের মাথার ওপর কোটি কোটি মশার স্তম্ভ। সে ক্যাম্পে আমার কোনও প্রফিশিযেন্সি ব্যাজ অর্জনের সুযোগ ছিল না। মিহিরের দাদা পচু পেয়্বছিল রান্নার প্রফিশইয়েন্সি। ফারস্ট এদের ব্যাজ পেয়েছিল কেউ কেউ।তার পরেরটা বোধহয চুঁচডো মাঠে। অর্গানাইজারদের মধ্যে ডাফ স্কুলের ( বাচ্চুদা), মল্লিকবাটি স্কুলের( প্রদীপদা) জাতীয় কয়েকজন ছিলেন, আমাদের কলেজিয়েটে স্কাউটিঙের কদর ছিল না। সেখানে নাকি সিগন্যালিঙের প্রফিশিযেন্সির পরীক্ষা হবে। অন্য কয়েকজনের সঙ্গে আমাকেও তালিম দেয়া হল। সেমাফোর এবং মর্স ধাতস্থ হলেও, বাস্তব বুদ্ধি তখনও পাকেনি (এখনও পাকেনি), তাই পূর্বনর্ধারিত মেসেজটি আগেভাগে মুখস্থ করা থাকলেও, বিবেকের দংশনে সেটা উগরোতে পারিনি। মেসেজটি ছিল Always Alert Accident Avert.সেটা এত বছরেও ভুলিনি।স্কাউটিঙেও চীটিং দেখে আমার অনুরাগে ভাটা পড়ল। শেষ ক্যাম্পটা ছিল গঙ্গানগরে– রাজস্থান নয়, মধ্যমগ্রামের হৃদয়পুরের কাছে যে গঙ্গানগর, সেখানে একটা স্কুলের মাঠে।সেখানে তখনো ছিল অন্ধকার, তখনো ছিল বেলা। সে ক্যাম্পে বন্ধু হয়েছিল অনেক।আর কিছু নয়। সি,এ,এস,সি- র আলোক ঘোষ বোধহয় সভাপতি ছিলেন। আর সে গঙ্গানগরে গঙ্গা খুঁজে পাইনি।





সেই জোনাকিরা (সংযোজন) In English, for a change

18 07 2019

I was once proud of my memory. Based on that I had painstakingly tapped out a memoirs on my unsmart Nokia X2 phone for my blog site. My daughter had published it asসেই জোনাকিরা from Delhi for free distribution to acquaintances. But I was not satisfied with it, for it had many omissions that I detected while reading it at leisure.

This is to fill in the blanks, if blanks they are.But I shall not vouch for it.

There is no mention of my first ever trip to Sah’ganj

in the original. blog post.

I was born in November 1946, delivered in my mother’s bed room at my grandfather’s Calcutta flat at 202,Rashbehari Avenue by my physician grandfather himself. And I’ve been told that I was brought to Sahaganj when I was about 2-1/2 years. That tallies with my memory.

It was in. The early part of 1948 that my father who was already ensconced at Sahaganj escorted mother and myself to a local train,early one weekend morning. The electric trains with EMU coaches wouldn’t be introduced till 1957. So it was one of the brick red rakes that used to ply the route then. They had nominally upholstered seats slightly more comfortable than the EMU coaches.it was by no means my first train ride. I’d been a veteran, having been to Shantiniketan,Patna and Lucknow before.

I made a bed of the seat using my mother’s lap as the pillow. At Liluah, some People boarded our compartment. An elderly lady among them, sporting a white sari that passed as widow’s weed in She Bengal. She politely requested my father to help her stow away her cloth bundle on the overhead rack. I decided that she was at least one hundred and a witch at that. To me anybody older than my parents would be one hundred years old. My mother made some room for the lady. She sat down. I wriggled a bit to preserve the cool feeling of the lightly pimpled green artificial leather of the upholstery that was embossed with the logo ER In a hexagon. “Don’t you like to look outside the window?” “What’s there to see anyway? Some wires moving up an down some poles. Several split-tailed swallows sitting on the same wires without moving. The rainwater drains running along the tracks. Several clay-tiled huts. Some shy ladies squatting on the drains.”

“How old are you?” She asked me. “Must you know?” I retorted.”Okay,Okay,which class are you in?” “I don’t go to school, not yet”. “Then tell me your name.” Before I could reply, my mother blurted out, “Phalguni”. It was my name alright, but I didn’t like it. So I added that my real name is Aniruddha, Aniruddha Sen.” “Both are nice names. But do you know who were there original owners of those names?”

It was my. Chance to. Show off my precocious knowledge of the Mahabharata. She. Was duly impressed. ” You didn’t learn all that in a school. No my grandparents are better than most schools. “What are their names?” “Shachindranath and Sudharani”

“Dr. Shachindranath Sen, you mean? Where does he live now? His Nasipur house was vacant last year.”

“How do you know him?”

“Why shouldn’t I? He saved my father’s life in Vaidyanathan-dham”.





ভূয়োদর্শন

25 05 2019

রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যর নোবেল চুরি গেছে তা কি, ভবিষ্যত বা়ণীতে নোবেল থাকলে তিনি অনেক কটা পেতেন। শতাধিক বছর আগে তিনি টাং ইন চীক লিখে গেছেন,

“যাও ঠাকুর চৈতন চুটকি নিয়া,

এস দাডি নাডি আলিমুদ্দিন মিয়াঁ॥”

সাধ্বী টিকি রাখেন কিনা জানা নেই, এত বছরের ব্যবধানে তিনি ভুল দেখেছেন হয়তো, তবে থাকতেও তো পারে। হুইস্কি সোডার সঙ্গে মুর্গি মটন না হয়ে বড় পাঁঠা হলে হয়তো গজাত। আলিমুদ্দিনে আজ কি কেউ দাডি রাখে?

“তা ছাডা, সাধ্বী এলেন, মিয়াঁ গেলেন ” টা উল্টে গেছে। বেশ কয়েকটা নোবেল পাওয়ার যোগ্য।





ঠাকুমার ড্রেসিং টেবল

19 03 2019

ঠাকুদ্দার ২০২, রাসবিহারী এভিনিউয়ের ৫ নং ফ্ল্যাট, তাঁর শোবার ঘরটা ছিল সব শেষের ঘরটা।আসবাবপত্র যে খুব বেশি ছিল, তা নয কিন্তু মনে হত ঠাসা। একটা ডবল খাট, তার হেডবোর্ডটায আল্পনার মত কেয়ারি করা, মশারির ছত্রি গুলো খোলা হতনা কখনও। তার চার পাযায চারটে পিঁপড়ে আটকানোর লোহার বাটি। কানা তোলা বাটির মাঝখানটা উঁচু মতন, খাটের পাযা গুলো তারই ওপর বসানো। অবতল অংশে জল থাকার কথা, যাতে পিঁপড়ে উঠতে না পারে, সেখানে জল নয, জমে থাকত রাজ্যের আবর্জনা। একটা কাঠের আলমারি, তাতেও অনুরূপ আল্পনার আঁকা। একটা ড্রেসিন টেবল, আযনাটা দামি, মাঝখানে একটা লম্বা ড্রয়ার, ওপরে ছোট ছোট আরও দুটো। আযনাটার অ্যাঙ্গল চেন্জকরা যায়। একটা লেন্সের ট্যাবের ওপর একটা মাসের শিঙের ট্রে, কার ওপর নানান টুকিটাকি। ছোট ড্রয়ার দুটোতে মা আর জ্যেঠার চিরুনি-ফিতে-কাঁটা। লম্বা টানাটান ভিড়ের বাসের মত ঠাসা। আনন্দবাজার পেতে তার ওপর দুটো সিঁদুরকৌটো, সেও হযতোমোষের শিঙের-পুরীতে কেনা বলে আমার আন্দাজ। একটা প্লেয়ার্স নাম্বার থ্রি সিগারেটের কৌটোর মুখে একটা বডো পেরেক, তার চেপ্টা মাথাটা সিন্দুরলিপ্ত, একটা ভেসলিনের শিশি, সেটাও নিশ্চয়ই টিপ প পরার জন্য, গুচ্ছের চিরুনি, শোযানো একটা কিউটিকিউরা ট্যালকমের কৌটা। দুটো পন্ডসের ফেস পাউডারের চাকতি কৌটো। একটা কুঙ্কুমের শিশির দেখেছি মাঝেসাজে। সেসব বোধহয মা, জ্যেঠা, নমিতাদি আর পিসির এজমালি সম্পত্তি।

আজ স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মনে হচ্ছে, ঠাকুমা নয, সবই হয়তো মা জ্যেঠি পিসি আর নমিতাদির সম্পত্তি। লম্বা ড্রয়ারে এ ছাড়াও আরও অনেক কিছু থাকত, মনে নেই, যাচাই করার সুযোগও নেই।স্থানান্তরণের পর বাডিটাই ভেঙে ফেলেছে এখনকার মালিক।

বলতে ভুলেছি খাটের পায়ের কাছে ছিল একটা সাবেক আলান, তাতে শাড়ি ধুতি ছাড়াও দাদুর ওয়ার্কিং স্টিকগুলো ঝুলত, তার পাদানিতে বিবিধ চটি। ঠাকুমা সহাযিকা ক্ষান্তপিসি বলত, “সাহেব বাডি থেকে কেনা জিনিস বলে তার জেল্লা োঅযত্নেও অটুট। অন্য ঘরগুলোর অন্যান্য আসবাবপত্রের সে জলুস ছিল না।

ড্রেসিন টেবিলের ডানদিকের ছোট ড্রয়ারে থাকত একটানা কাগজে রুল টানা প্যাড, একগুচ্ছ বিনা টিকিট ও স্ট্ডাকমাশুলযুক্ত সাদা খাম, কিছু না লেখা পোস্টকার্ড আর ইনল্যান্ড। ঠাকুমা চিঠি লিখতেন প্রচুর।

আমার নজর ছিন লম্বা টানাটার ওপর। সেখানে প্রায়ই হিসেব ছাডা রেজগি থাকত। থাকত বাবার সিগারেটের খালি টিন,এবং ছোটদের মন কাড়া আরও কিছু টুকিটাকি।সবচেয়ে লোভনীয় ছিল ঠাকুমা রীডিং লেন্স–দশ সেকন্ডে রোদ্দুর ফেলে কাগজে আগুন ধরানো যেত। আমার আজন্ম লোভ ছিল সেটার ওপর।

আমি একটা NP চিউইং গামের প্যাকেট লুকিযেছিলাম সেখানে- একটা বেওযারিশ ফিল্মের কৌটোয, যাতে দাদা (জ্যেঠতুতো) খুঁজে না পায। সেও পায়নি, আমিও পাইনি, কে পেয়েছিল কে জানে!

কেউ না পেয়ে থাকলে এদ্দিনে ফসিল হয়ে গেছে, চিবুনো যাবেনা।





,আযমার নমিতাদি

11 03 2019

আমার চেয়ে অনেকটা বড়ো ছিল নমিতাদি; দশ বছর তো হবেই, পনেরোও হতে পারে। কলেজে-ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় আমার ঠাকুর্দা-ঠাকুমার ২০২ রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ের ফ্ল্যাটে থাকত। তার মাকে পিসি বলতাম: আপনের চেয়ে কম কিন্তু গ্রাম-সুবাদের চেয়ে বেশি। রমা-নমিতা-মায়া, তিন বোন, কিন্তু একা নমিতাদি আমাদের সঙ্গে থাকত। সেটাও অতিশয়োক্তি, কারন আমরাই ও বাড়ির স্থায়ী বাসিন্দা ছিলাম না–শনি-রবি বা ছুটিছাটাতে আসতাম।

এখন পশ্চাদ্দৃষ্টিতে বুঝি, নমিতাদির বয়স ছিল আমার আর মায়ের বয়সের মাঝামাঝি, হয়তো আমারই কাছাকাছি, তাই আমার সঙ্গে ভাব ছিল খুব। বহাল তবিয়তে কিনা জানিনা, তবে শুনেছি, সে বেঁচে আছে, আছে কলকাতাতেই, কিন্তু উদ্যোগ করে তার সঙ্গে দেখা করা হয়ে ওঠেনি।





পালপাড়ার ক্ষান্তদিদি

11 03 2019

চুঁচডোর স্কুলে পড়তাম যখন, তখন সেখানকার অলিগলির সঙ্গে একটু পরিচিতি জন্মানো স্বাভাবিক। ১৯৫৭-র সাধারণ নির্বাচনের ঠিক আগে মাস্টারমশাইরা রোজ একবেল ভোটের কাজ শিখতে চুঁচডো কোর্টে যেতেন। ক্লাস হতনা। সেই অবসরে স্কুলবাসের জন্যআমাকে চার্টে অবধি থাকতেই হত। সেটাই আমার চুঁচডো চেনার সুযোগ। নইলে আমি তো দূর শা’গন্জের ছেলে, পাঁচ মাইল, মানে আট কিলোমিটর দূর, আর সুযোগই হতনা।

পালপাড়ার কাঁচা গলিতে তখন বস্তির মত খুপরি ঘর ছিল অনেক, আবার অট্টালিকাও ছিল। দুটো অট্টালিকার মাঝখানে একটা বস্তি, সেখানে থাকত ক্ষান্ত দিদি। একদিন বৃষ্টির মধ্যে নিরুদ্দেশ হাঁটতে দেখে ডেকে নিয়েছিলেন আমায়।না ডাকলেও চলত। তাঁর খাপরার ঘরে নিতাই অভাব,তায আবার আমার মত শঙ্করা।একটা থান দিয়ে মাথা মুছিযে দিয়ে ভেজার জন্য পাঁচ মিনিট বললেন।তারপর বললেন, “ওই সরকারী স্কুলে পডিস না? ছুটি তো বাডি যাসনি কেন?”

সে কেনর উত্তর দিতে অনেক সময লেগেছিল; আমিও অনেক কিছু জানতামনা, ক্ষান্তদিদি তার পাড়ার বাইরে কিছুই জানত না। আমায় জিজ্ঞেস করলেন, “ভাত খেয়েছিস?” বললাম ভাত খেয়েই তো স্কুলে আসি।ক্ষান্তদিদি বলল, আমাদের তো ভাত চলেনা, না হলে তোকে খেতে বলতাম। ভাত চলেনা মানে? খাও কি?

“আমরা গরিব, কেউ রোজগারের নেই। মাঝে মাঝে ভাগ্যে থাকলে বসন্তবাবুর মুদিখানা থেকে দু-আনার খুদ আনি। তাই ফুটিযে জৈ বানিয়ে খাই। পাকা তেঁতুল, নুন, লঙ্কা দিয়ে মেখে। বাবাকে প্রশ্ন করে পরে জেনেছি, জই একরকম খুদের পরিজ, গরিবের আহার ছিল৭৫-এর মন্বন্তরে, আর শতাব্দীপ্রাচীন মঙ্গলকাব্যের যুগে।

আর কখনও জই খাওয়া মানুষ দেখিনি। সে যুগে সুখ যেমন ছিল অপরিসীম, কৃচ্ছও ছিলবড্ডো বেশি।বহু বছর পর একবার রাঁচির বুন্ডুতে এক গ্রামে অ্যালবার্ট বলে এক আদিবাসী যুবক তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে জই খাইযেছিল। তবে সে শৌখিন জই, দুধ চিনি দিয়ে তৈরি।

ক্ষান্তদিদি বডো সুন্দর ছিল। দীঘল গড়ন, টানা টানা চোখ, ঈষৎ লালচে চুল, বেড়ালের মত কটা চোখ। জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার কে আছে? মা আর বোন আছে, আমার সঙ্গেই থাকে। বাবা? নারে, মায়ের একটা বর ছিল, সে আমার বাপ নয। বাপ যে কে, তা মাও ঠিক জানেনা। যাকে পেলে মা খুশি হত, সে ওতোরপাডার লোক, আমরাও তাই, তবে তারা নাকি মুখার্জি, আর আমরা তো বেদে। চুঁচডো ইশটেশনের কাছে যখন পূব বাঙলার রেফুজিদের নতুন জায়গা জমি দিল োআর ঘর তুলনার জন্য ১০,০০০ টাকা, আমরাও সরকারি বাবুদের কাছে গিয়ে বলেছিলাম, আমরাও তো রেফুজি, ওতোরপাডার রোফুজি, শুনেতারা হেসে বললে, প্রমাণ দাখিল করো। কি প্রমাণ দেব আমরা? তাই হল নে।

জইযের সঙ্গে কি খাও তোমরা?

এই আমার পুঁই মাতা, রান্নাঘরের চালে নাউ ফলে, মদন পালের মজা পুকুরের কিনার থেকে মাঝে মাঝে কচু তুলে আনি। ওল তো এদেশে কেউ খাযনা।দিব্যি চলে যায়। কি কর তুমি? আমি তো নেকাপডা শিখিনি, কে আমায় কাজ দেবে, মুরুব্বিও তো নেই কেউ। মাঝে মাঝে শংকর পালের বাড়ির মেয়েরা আমাকে দিয়ে রাঁধায।চাড্ডি পয়সা দেয। এমনি তো পয়সা লাগালে, তেলটা নুনটার জন্য এই যা।একটু আধটু বাঙলা লিখতে পড়তে পারি, পাড়ার কম বয়সী বউযেরা আমাকে দিয়ে বরের কাছে চিটি নেকায।

ক্রমশ





সেই জোনাকিরা (১৬–১৯ অন্তিম) ৷৷ অনিরুদ্ধ সেন

3 05 2013

There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the sixth and the final.

১৬ শুকতারাই সাঁঝতারা

মাস্টারমশাইদের কেউই ইহজগতে নেই আর: ফটিকচন্দ্র কুমার, শিশির সেনগুপ্ত, মীনাদি রীনাদি দুই বোন, হাসিদি, সুষমাদি, আরো কেউ কেউ বাদ গেলেন হয়ত৷ সহপাঠীদের মধ্যে এক দীপালী বাঁড়ুজ্যে ছাড়া কারু সঙ্গে যোগাযোগ নেই৷ মায়া সুরের সঙ্গে একবার পথ চলতি দেখা হয়েছিল, তাও বছর কুড়ি আগে; ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকিয়ে দারুন কবিতা বলত মায়া, “কাঠবিড়ালি, কাঠবিড়ালি, পেয়ারা তুমি খাও?” মায়ার জ্যেঠামশাই, মোহিনীমোহন, ব্যান্ডেল চার্চের উল্টোদিকে সেন্ট জন’স স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন; কেহ বা কাহারা তাঁর ঘাড়ে কাটারির কোপ মেরেছিল, জব্বর কোপ, অনেক ভুগে বেঁচে গিয়েছিলেন সেযাত্রা! তাঁর স্কুলে উনিশ দিন পড়েছিলাম, হুগলি কলেজিয়েটে ভর্তির অপেক্ষায়৷

বাবার তত্ত্বাবধানে হ-য-ব-র-ল নাটক হযেছিল একবার৷ সদ্য কামলামুক্ত আমি ন্যাড়া (লাল গানে নীল সুর, হাসি হাসি গন্ধ!… সুরহীনতাটা আমার সহজাত বলে তেমন মহড়া লাগেনি), সুজিত কাক্কেশ্বর কুচকুচে (হাতে রইলো পেনসিল), সমীর ছিল প্যাঁচারক (প্যাঁচা+বিচারক), সুভাষ ব্যা-করণ শিং, বি.এ., আর ডাক্তার দাসের মেজ মেয়ে মিন্টি পুং ভূমিকায় গল্পের আমি৷ রিহার্সল প্রায়ই হত আমাদের বাড়িতে, অধিকাংশ মুখোশ কলকাতায় কেনা, শুধু কুমিরের এবং আর দু একটা বাবা নিজের হাতে বানিয়েছিলেন। সেই সুযোগে সহপাঠীদের সঙ্গে ভাবটা আরও জোরদার হলো; খালি মিন্টি, আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত, ছিল স্ট্যান্ডঅফিশ, বরং বলা ভালো তুষার কুমারী — অত রিহার্সল সত্ত্বেও আমার সঙ্গে ভাব হয়নি কখনও৷ পরে একবার রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে স্ত্রীচরিত্রবর্জিত মুকুট নাটকে রাজধরের ভূমিকায় বাপি, আমি সেজেছিলাম ইশা খাঁ, সুজিত আর শিবু অন্য দুই রাজপুত্র। সম্ভবত সেবারই পুংবর্জিত নাটক হল বিসর্জন: রঘুনাথের ভূমিকায় শিপ্রাদি, জয়সিংহ তার বোন শীলাদি আর অপর্ণা বোধহয় পিনুদি; উঠতি বয়সের ছেলেদের ভিড় হয়েছিল খুব! সেসব নাটকের রিহার্সলটাই আসল, যত দীর্ঘায়িত তত মজা!

সুজিত বল  সে  আমল  থেকেই  আমার  প্রাণের  বন্ধু,  এখনোও তাই,  তবে  সে বাংলা স্কুল ছেড়ে গিয়েছিল বাঁশবেড়ে স্কুলে৷ দু দুটো হালকা হার্দিক ধাক্কা সামলে এখনও সে বহাল তবিয়তেই আছে, দেখা সাক্ষাৎ হয়৷ গীতা নন্দি আর মীনা পোড়েল — বয়েসে কিছুটা বড় তবে আমাদের সঙ্গেই পড়ত, দুজনেরই বিয়ে হয়ে যায় স্কুলের গন্ডি পেরুতে না পেরুতে৷ মীনা তার পরেই আত্মহত্যা করে: কারণটা কখনও অনুসন্ধান করিনি তবে সহজেই অনুমেয়৷ দুই কৃষ্ণার একজন, ভট্টাচার্য, ছেলে হতে গিয়ে মারা যায় কাঁচা বয়েসে; অন্য কৃষ্ণা, চক্রবর্তী, আর তার দুই ভাই, শঙ্কর (ক্লাসের একমাত্র ছেলে যে ড্রইঙের বদলে সেলাই শিখত মেয়েদের সঙ্গে) ও সমরও কোথাও হারিয়ে গেছে৷

নতুন এস্টেটে ঝোপ জলা জঙ্গলের খামতি ছিলনা, বর্ষায় জোনাকিও ছিল বিস্তর, তবু দিওয়ানা কবি হাফ়েজ়ের মত হা জোনাকি যো জোনাকি করে আমার সেই জোনাকিদের খুঁজতাম৷ সারাক্ষণ বললে মিথ্যে বলা হবে, মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে, অথবা আচমকা মনে পড়লে৷ তখনই বোঝা উচিত ছিল, কবি হওয়ার আসলি বীজ, নিষ্ঠা, আমার ভেতর নেই!

পিটর মাইকেলের পৈতৃক সাকিন ছিল বর্তমান ঝাড়খন্ডে, যত দূর শুনেছি রাঁচির অনতিদূরে বুণ্ডুর মুন্ডা বংশে তার জন্ম৷ তার জ্যেঠা ছিলেন কারখানার কর্মচারী, তখন চার্জহ্যান্ড, পরে ফ়োরম্যান৷ পিটর নিঃসন্তান জ্যেঠা-জেঠির কাছেই মানুষ এবং অমানুষ হচ্ছিল৷ এস্টেটের নবলব্ধ চুরাশি একর জঙ্গলের হাঁড়ির খবর জানত সে: কোথায় ঘুঘুদের আস্তানা (ইউ ক্যান রোস্ট দেম অন উড ফ়ায়ার… ডিলিশস্); কোথায় কুন্ডুদের পরিত্যক্ত শিব মন্দির, যেখানে খোঁড়াখুঁড়ি করলে গুপ্তধন মিলতে পারে; কোথায় লিচু পেকেছে কিন্তু জমাওয়ালার জাল পড়েনি এখনও৷ একটা সময় আমার সঙ্গে জমেছিল খুব, বোধহয় আমার এয়ার রাইফেলের দৌলতে৷ জঙ্গলের সব খবর রাখত সে, তবে সেই জোনাকিদের নিশ্চয়ই চিনতনা, সেই উল্টোনো জবার মত, গহন সমুদ্রের উজ্জ্বল আর বেপথু জেলিফ়িশদের মত, ফিসফিস করে কথা বলা জোনাকিদের; চিনলে কি আর বলতনা আমায়? উঠতি অবস্থার জ্যেঠা জেঠি ভালো বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়েছিল তাকে, পিটর তাঁদের বংশে গৌরব আনবে প্রথম! কিন্তু অদৃষ্টের রসিক দেবতা আরেকবার হাসলেন: স্কুল থেকে কোথাও পিকনিকে গিয়ে সাঁতার কাটছিল সে, জলের নিচে চোরা পাথর তাকে রেয়াত করেনি৷

কানাই পিটরের চেয় বেশি জঙ্গুলে ছিল: ঈশ্বরবাগে তাদের বাড়িতে গেছি একবার, তার মা বললেন, “ঘরে নেই, দেখোগে উত্তুরের পুকুরে ডালঝাঁপ খাচ্ছে হয়ত”৷ উত্তরের পুকুর তো বুঝলাম, কিন্তু ডালঝাঁপ কি ভালো খেতে? পানিফলের মত জলে ফলে? গিয়ে দেখি, একটা গাছের ডাল পুকুরের প্রায় সমান্তরাল হয়ে ঝুঁকে রয়েছে; কানাই তাতে চড়ছে আর জলে ঝাঁপাচ্ছে৷

…আরেকবার কানাই আমায় ডিম ষষ্ঠীর নিমন্ত্রণ করেছিল৷ আর সব ষষ্ঠীর নাম শুনেছি, তা বলে ষষ্ঠী আর ডিম! পেঁয়াজি পেয়েছ? সেদিন সরস্বতী পুজোর ভাসান, স্কুল ছুটি৷ যথাসময়ে গিয়ে শুনি, শ্রীপঞ্চমীর পর দিন সরস্বতীর বাহনের খাতিরে ষষ্ঠী: ঘরে পোষা হাঁসের ডিম সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, কুমড়ো সেদ্ধ দিয়ে ভাতে ভাত খেতে হয়, আমরাই খুঁজে পেতে এনেছিলাম  পাত পাড়ার পদ্ম পাতা;   ছেলেমেয়েদের  সে  সব  খাইয়ে তবে মা সেই পাতে খাবে,  হাতে  বাঁধবে নজর এড়াবার কালো সুতো৷ সর্ষের তেল আর কাঁচা লঙ্কা চলতে পারে, পেঁয়াজ নৈব নৈব চ!

মাটির অত কাছে থেকেও কানাই সেই জোনাকিদের দেখেনি৷ বড্ড গরিব ছিল কানাইরা, পড়াশুনো চালাতে পারেনি; শুনেছি, ঈশ্বরবাগেই দোকান দিয়েছিল একটা৷

শা’গঞ্জের বাংলা স্কুলে ছটা মাত্র ক্লাস৷ কথা ছিল বছর বছর একেকটা ক্লাস বাড়বে, কিন্তু বরাদ্দ এবং স্থানাভাবে সেটা শুরুতে মেয়েদের জন্য শুধু৷ কাজে ১৯৫৭তে সপ্তম ক্লাসে উঠে শহরের স্কুলে যেতেই হল৷ একে বেপাড়ার, তায় বেড়ে ক্লাসে বেঁড়ে ছেলে! বয়েসটা একটু কম বলেই বিপত্তি বেশি; প্রতিষ্ঠা পেতে লড়াই করতে হয়েছিল রীতিমত৷ যে কথা অন্যত্র বলা হয়নি তার মধ্যে আশরফির গল্পটা জরুরি হয়ত৷ জরুরি আর কি, সে অবশ্যই — জোনাকি নয় — তবে তেমনই অধরা কিছু একটা খুঁজত৷ কলেজিয়েটের গেটের বাইরে, টিপিনের এবং ছুটির সময়, খোলা সুদ্ধ বাদাম, ছোলা ভাজা, ঝাল ছোলা, ছোলা টোপার ঝুড়ি নিয়ে বসত সে; অন্য সময় টাউন ক্লাবের মাঠে কিংবা নদীর ধারে৷

একদিন, ক্লাস সেভ়েনেই হবে কারণ সেটা ছিল ইলেকশনের বছর, ১৯৫৭, মাস্টারমশাইরা ভোটাভুটির ট্রেনিঙে গেছেন সব, হাপ ছুটি, কোম্পানির ফিরতি বাস আসতে আসতে সেই সাড়ে চারটে৷ একেকদিন দপ্তরি শুকুল চাচা লাইব্রেরিতে বসে বইপত্র ঘাঁটতে দিত হেডমাস্টারমশাই পি.কে. সেনের সস্নেহ প্রশ্রয়ে, অবশ্যই লাইব্রেরি ঘরের এক কোণে নিজের খুপরি টুকুতে অন্য কোনও কাজ থাকলে৷ না থাকলে ফাঁকা স্কুলে চড়ে খাওগে৷ সেখানে নাকি মহসিন সাহেবের কোন বিবির ভূত এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়, প্রবাদ অনুযায়ী নিশুত, নিঃঝুম দিনমানেও৷ একদিন কি করি কি করি করতে করতে ষাঁড়েশ্বরতলা ঘাটে বুড়ো বটের ছায়ায় গিয়ে বসেছি, দেখি আশরফি পৈঠায় ঝুড়ি নামিয়ে উদাস চোখে গঙ্গার স্রোত দেখছে, চারদিক শুনশান — জনমনিষ্যি নেই৷ সেই থেকে বুড়োর সঙ্গে আমার গলাগলি ভাব৷

আশরফির গল্পটা বহু কাল আগেই, বোধহয় কলেজে থাকতে, একবার লিখেছিলাম, তাই খুঁটিনাটি অনেকটাই মনে ছিল; যদিও সে যাত্রায় আগা এবং লেজা হীন সে লেখাটা ধোপে টেঁকে নি; কাঙ্ক্ষিত পত্রিকার সম্পাদক পত্রপাঠ বাতিল করেছিলেন, টিকিট মারা ফিরতি খাম সঙ্গে দিই নি বলে ফেরত পাঠান নি৷

মোকামায় থাকতে রুজি রোজগার ছিল না আশরফির; ওইটুকু খেতির ফসলে অতগুলো লোকের চলে! অগত্যা চাচার কাছে নৈহাটি৷ এসে দেখে, চাচার কামাই বিস্তর, তবে হারামের কামাই, ডাকা ডালনেকা পয়সা! চাচার দলেই শেষমেশ ভিড়ে গেল আশরফি, তখনই তার দেড়কুড়ি দুকুড়ি বয়েস, বাঁজা বউটা মরে বেঁচেছে৷ চাচার এক নম্বর বেওসা নৌকোয় যাত্রী পারাপার৷ রাত হোনেসে সেই নৌকো নিয়েই অভিযান: চরেরা খবর আনত; খবর বুঝে কোনও দিন এখানে, কোনও দিন সেখানে, মাসে কমসেকম দো’তিন রোজ ডাকা ডালতা থা চাচার দল৷ গেরস্ত সজাগ থাকলে বা বেগতিক বুঝলে কাজ হত না; সে সব দিন মেজাজ টঙে তুলে দারু খেত চাচা আর লাল লাল চোখে আশরফিকে গাল পাড়তো৷ ভাগের বেলায় কিন্তু অষ্টরম্ভা: কখনো সিকিটা কখনো আধুলিটা, কখনো শুধুই  রক্তচক্ষু!

একা আশরফি ধরা পড়েছিল সেবার, সেই একবারই এবং শেষ বার৷ কাল বাদে পরশু যে বাড়িতে বিয়ে, গয়নাগাঁটি, নগদ টাকা, বেনারসি, কাঁসা পেতলের বাসন তো থাকবেই, বাড়ি ভর্তি কুটুমও থাকবে;  সে সব জেনেই তো আসা! সচরাচর বন্দুক দেখালেই কেঁচো হয় যায় লোক, মেয়েছেলেরা  চোখের  জল  ফেলতে  ফেলতে  হাহাকার  করে  ঠিক  কিন্তু নিজের নিজের গলার হার, কানের পাশা, হাতের বালাও  স্বেচ্ছায় খুলে দেয়৷ সেদিন, সেই ছোকরি, যার  কাল বাদে পরশু বিয়ে, তারই গায়ে গলায় হাত দিল চাচা!

“কি সুন্দর মেয়েটা, খোকাবাবু, কি মাসুম — তোমাকে তা কি করে বোঝাই! তোমার তো বোঝার বয়েসও হয়নি; তা ছাড়া আমার দিলে যা হচ্ছিল সেটা বলবার মত ভাষা আমার নেই৷ নরম চাঁপা রঙের মেয়েটার মুখে চোখে ইজ্জতের ভয়, এখনো চোখ বুজলে দেখতে পাই৷ আমি বারবার চাচাকে মনা করছিলাম, হাত ধরে টেনেও ছিলাম, সেই দেখে মেয়েটা কেমন তাকিয়েছিল আমার দিকে, হয়ত আশ্বাস চাইছিল৷ কি করে ভুলি!

“মেয়েটার কোনো আত্মীয়, হয়ত ভাইয়া, চাচাকে ছাড়াবার চেষ্টা করছিল; ধস্তাধস্তিতে এমন হয়ে গেল কি খালেদের হাতের বন্দুকসে গোলি ছুটে গেল আর মরলো সেই ভাইয়া৷ মেয়েটার গায় হাত দিচ্ছে চাচা? আমার গুসসা হল৷ হতভম্ব খালেদের বন্দুকটা কেড়ে নিয়ে চাচাকে ঝেড়ে দিলাম৷ সবাই দেখল কিন্তু বিচারের সময় সে কথাটা বললনা কেউ, বললে কিছু কমসম সাজা হত হয়ত! ধরা পড়লাম আমি একা, বাকি সব এ তল্লাট থেকেই পালালো, গয়নাগাঁটি নিয়ে৷

“আমার উমর কয়েদ হল৷ আঠেরো মাস রেমিশন নিয়ে সাড়ে বারো বছর খেটে বেরিয়ে এই সাত দস সাল বাদাম বেচছি৷ ভাইয়াটা তো মরেই গেল; মেয়েটা আছড়ে পড়েছিলো তার ওপর, আমি এখনো দেখতে পাই৷”

“কি দেখ, আশরফি?”

“আমি সেই মেয়েটাকে দেখি৷ বিচারের শেষ অবদি, জানি, তার বিয়ে হয়নি৷ তার পর তার কি হল? হিন্দুরা কি আর বিয়ে দিতে পারবে?…সে কোঠিতে তারা আর থাকেনা, খোকাবাবু, আমি দেখে এসেছি৷”

“তুমি কি তাকে দেখতে চাও?”

“এসব কথা বোঝার বয়েস তোমার হয়নি, খোকাবাবু৷”

আমার নিজের দিলের ভেতরকার যে আকুতি, সেই জোনাকিদের জন্য যারা দেখা দিয়ে হারিয়ে যায়, তার কথা তো আশরফি জানত না, জানার কথাও নয়, কাউকে এতদিন বলিনি সে কথা!

###

১৭ দেখা নাদেখায় মেশা

১৯৫৪ থেকে ১৯৬৫ ওই ১১৬ নম্বর ছিল আমাদের ঠিকানা, হাল সাকিন ও অভয়াশ্রম৷ তার মধ্যে ১৯৬২র মাঝখান থেকে ১৯৬৫র মাঝামাঝিঅবধি কাটিয়েছি কলকাতায় (যে শহরটা এখনও আমার নিজের হল না!) পড়াশুনোর অজুহাতে৷ সেই নতুন এস্টেটেই আমার যথার্থ বয়ঃপ্রাপ্তি,  ছেলে থেকে লোক হয়ে ওঠার প্রথম সোপান৷ কিন্তু, সুধী পাঠক, আমি পিটর প্যানের মত চিরকিশোর থাকতে চেয়েছিলাম৷ যে ভগবানকে কখনও মানিনি, তার দিব্যি, নতুন স্কুলের বেনেবাড়ির ছেলেরা যেমন বাঁ হাত দিয়ে একবার কণ্ঠা একবার চোখ ছুঁয়ে দ্রুত লয়ে বলত, “sত্যি বলছি, মাইরি, মা কালির দিব্যি, চোক ছুঁয়ে বলছি, গণেs মানত”, সেই রকম দিব্যি গেলেও বলতে পারি, “আমি বড় হতে চাইনি, চাইনি, চাইনি!”

দীর্ঘতর সময়, হয়ত পাকাপাকি, চিরকাল, পরবাসে কাটানোর কথা ছিল, পাখির ছানা যেমন উড়তে শিখলে নিজের মনেই অন্য কোথাও চলে যায় — হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে জীবনের বন কেটে নিজের বসত  বসায়৷ আমি নিজে এবং চেনাশোনা সকলেই তাই ভাবতেন, কিন্তু অদৃষ্টের রসিক দেবতা মৃদু হাসছিলেন তখনও! আমি লায়েক হবার আগেই আমার পূজনীয় পিতৃদেব সব দায়িত্ব আমার ঘাড়ে ফেলে সটকে পড়লেন ১৯৬৫র জুলাইতে৷ পয়সাকড়ি কিছু রেখে যাননি বলবনা, তবে এমনই তাঁর ইহলৌকিক জ্ঞান যে জীবিত কাউকে নমিনি করেননি! সেই থেকে শা’গঞ্জের ঘানিতে পাকাপাকি জুতে গেলাম৷ বিদ্যে সামান্যই, বুদ্ধি তথৈবচ, অনেকটাই পিতৃবিয়োগের আহা বেচারা সমবেদনা, বাকিটা লিখিত নির্বাচনী পরীক্ষা আর নির্দ্বিধার ইন্টারভ়িউএর খাতিরে সেই কারখানাতেই চাকরি হল একটা, তিন বছরের ম্যানেজমেন্ট ট্রেনি৷

চেনা মানুষ, বিশেষ করে বাপের চেনা মানুষদের সঙ্গে কাজ করার হ্যাপা অনেক: একে তো বয়স্করা বাজে বকে বেশি, তায় পদে পদে গঠনমূলক তুলনা ও সমালোচনা!

“আর্য সেন বিরাট পন্ডিত ছিলেন, তোমার মত ফাঁকিবাজ না৷”

“এই যে তুমি ক্ষীরোদ করের চায়ের দোকানে চ্যাংড়া ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা মারো, এটা কি আর্য সেনের ছেলের পক্ষে শোভন?”

“তুমি শেষমেষ সত্যিই অনার্স পেয়েছিলে? সেনবাবু তোমার পরীক্ষার মধ্যেই মারা গিযেছিলেন না?”

ততদিনে আমরা ১১৬ ছেড়ে সান বারান্দাহীন ১৬৯ নম্বরে উঠে গেছি, বলা ভালো নেমে গেছি, এবং অচিরেই সেখান থেকে আরও নেমে সাবেক শা’গঞ্জ কেওটার টায়ারবাগানে, গোবিন্দ ঘোষের সন্তোষ কাসটে, কারণ বিজ্ঞপিত ইংরেজি গৃহপরিচিতির শেষ দুটো অক্ষর খসে গিয়েছিল৷ সেখান থেকে আবার লাটবাগানে, সুহাস সেনগুপ্তর নামহীন গৃহে, সন্তোষ কাসলের মত নিস্প্রদীপ নয়৷ সুহাসবাবুর এক ছেলে, সুরজিত, বাংলার ফুটবল দুনিয়ায় স্বনামধন্য, আর এক ছেলে প্রতিষ্ঠিত ভূতত্ত্ববিদ্ ও আমার সমপাঠী; সহপাঠী নয় কারণ সে পড়ত ব্র্যাঞ্চ স্কুলে৷ বহুদিন আগে জ্যোতিষ (যতীশ?) কাকা প্রায় জোর করে বাবাকে কিনিয়ে দিয়েছিলেন একটা প্রমাণসই জমি, জলের দরে, বড় রাস্তার ওপর এবং, জনধারণায়, কেওটার তখনকার রইসতম পাড়ায়, যেখানে চক্ষুবিদ নীহার মুনশির নিজের এবং তাঁর আত্মীয়বর্গের বাড়ি৷ অদূরেই ভাগীরথী সতত প্রবাহমানা, ব্যান্ডেল চার্চ চারশো গজ, স্টেশন তিন মাইলের কম, কারখানা আধ কি পৌনে মাইল!

১৯৬৮তে, এস্টেট ডিউটি দিয়ে সাকসেশন সার্টিফিকেট পাওয়ার পর, বাবার মৃত্যুজনিত কারণে প্রাপ্ত ও কিঞ্চিত সঞ্চিত অর্থে একটা ভদ্রাসন তৈরি হল সেখানে,  আমার পরম বন্ধু, পরে সাতাশ বছর ধরে আমার সহকর্মী, সদ্য পরলোকগত স্থপতি সুবীর সেনগুপ্তের নকশায়৷ নকশাটা অনন্য বলা যাবেনা কারণ কনট্র্যাকটর টোগু বাবু, যিনি সুবীরের সন্ধান দিয়েছিলেন, আমাদের বাড়ি তৈরির বছর দুই আগে প্রায় একই নকশার আরেকটা বাড়ি বানিয়েছিলেন চন্দননগরের পুরশ্রী কলোনিতে, সুবীরেরই ডিজ়াইনে; ট্রেনচলতি দেখা যেত এবং ডেলিপাষন্ডদের নানান আলোচনার বিষয় ছিল সেটা৷

মিল কন্ট্রোল ল্যাবের জটা গাঁজারু এবং কোকেনসেবী ছিল তো বটেই, তবে সদ্য মিক্স করা রাবার কমপাউন্ডগুলোর মনের কথা শুনতে পেত সে; মুনি বা রিওমিটার যন্ত্রে না চড়িয়েই স্পর্শে, চর্বণে, দলনে ও ঘ্রাণে সে তাদের ভিসকসিটি, অন্তত দুটো তাপমাত্রায় স্কর্চ সেফ়টি, কিওর টাইম, কিওর রেট ইত্যাদি হুবহু বাতলে দিতে পারত; বিশ্বাস না হলে মিলিয়ে নেওয়ার চ্যালেঞ্জ ছিল — কখনও জিততে পারিনি৷ পাকেচক্রে দেখা গেল, আহা উহু সমবেদনা ছাড়া আমারও একটা ঐশী ক্ষমতা আছে — জটার চেয়ে কম নয় কিছু৷ রাবার (কলচলতি ভাষায় রবাট, কারখানাটার ডাকনাম রবাট কল, আমরা সব রবাট কলের কুলি) নামক পলিমারগুলোর বিশাল অণুরা আমার কথা শুনত৷ সত্যি, প্রায় বিনা চেষ্টায়, রেসিপি দেখে বা নতুন রেসিপি উদ্ভাবন করে, স্ট্রাকচার বুঝে, প্রণিধানযোগ্য স্থাবর ও জঙ্গম প্রপার্টিগুলো অক্লেশে বলে দিতে পারতাম ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মত! হয়ত তারই জন্যে অচিরাৎ ফ্যাক্টরি টেকনিকাল ছেড়ে দ্রব্যগুণের গবেষণাগারে জায়গা হল আমার, নতুন গবেষণা ও উন্নয়ন বিভাগে৷ অথবা, বলা ভালো, গবেষণাগারগুলোর সরকারি স্বীকৃতি এবং আর অ্যান্ড ডি-তে উত্তরণ হল যৌথ প্রচেষ্টায়, তাতে আমার দায়ভাগের (আর পাঁচ বছর ধরে মেহনতের) দাবি ছিল অনেকটা৷

গবেষণা হল গো+এষণা, গোরু খোঁজার কাজ৷ ওই রাখালিয়াপনাটা আমার সহজে আসতো, আগের জন্মে ব্রজের গোপ-বালক ছিলাম কি না কে জানে! ১৯৭৩ সাল, পশ্চিম এশিয়া সংকট এবং ওপেক সংগঠনের সব-নিংড়োনো অর্থনীতির শুরুয়াৎ৷ কাজেই আমার করে দেখানোর বিস্তর বিষয় ছিল৷ তারপর আর ফিরে দেখিনি কখনো; শুধু বিভাগের মাথা হয়ে ওঠার আগে বিদেশ থেকে একটা দুটো খেতাব আর পিঠচাপড়ানি  অর্জন করতে হয়েছিল৷

অদৃষ্টের রসিক দেবতা এবার অট্টহাসি হাসলেন! নতুন মালিকদ্বয়ের আবাসিক অংশিদার তাঁর সদ্য বিশ পেরুনো ছোট ছেলের জন্য ভারতীয় কোম্পানিটা কিনে নিলেন; সহক্রেতা নাম না জানা কে এক অনাবাসী৷ বিলিতি হোল্ডিং কোম্পানির হাঁড়ির হাল, আগেই শুনেছি; এখন লীড ব্যাংকার, বার্কলে, ঋণের বোঝা লাঘব করতে গোটা কোম্পানিটা টুকরো টুকরো করে বেচে দিল, এদেশের কসাইরা যেমন করে অনায়াসে জনসমক্ষে মাংস বেচে৷ আপাদমস্তক ছাল ছাড়িয়ে হেঁটমুন্ড ঝোলানো — দাপনার দাম এত, সিনার দাম তত, এমনকি শিং সুদ্ধ মাথা আর খুর সুদ্ধ পায়ারও আলাদা দাম ধরা আছে৷ ছাল কিনবে, ছাল? ডেলা পাকানো চর্বি? সব পাবে: ইংল্যান্ড, জর্মনি, ফ্রান্স, দক্ষিণ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজ়িল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়… মায় হিন্দুস্তান হমারা!

নতুন মালিকদের মতলব কি কে জানে!

১৮৮৮  সালে বার্মিংহাম শহরে যাত্রা শুরু করেছিল যে দিশারী প্রতিষ্ঠান, ভারতে যার নথি-ভুক্তি ১৮৯৮তে এবং শা’গঞ্জে কারখানা স্থাপন ১৯৩৬ সালে, বণিকের মুদ্রানিক্বণে তার খাসি করা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিক্রি হল হঠকারিতায়! আমার ব্যক্তিগত ভাগ্য কিছুটা স্তিমিত হলেও তখনও ঊর্ধমুখী৷ তারও পরে গজকচ্ছপের লড়াই শুরু হল, দুই অংশিদারের দখলদারির পারস্পরিক লড়াই৷ অস্যার্থ, কারখানায় অশ্রুতপূর্ব সাতানব্বুই দিনের ধর্মঘট৷ পয়সার খেলা, বোঝাই যাচ্ছিল, কিন্তু কার পয়সায় দুটি ইউনিয়নই এই আত্মঘাতী খেলায় মাতল, সেটা বুঝতে সময় লেগেছে৷

এই কারখানাকে লোকে বলত মহীরূহপ্রতিম শিক্ষণ সংস্থা; ভারতময় তুল্যমূল্য অন্য প্রতিষ্ঠানে শা’গঞ্জে-কাজ-শেখা উচ্চ মার্গের লোকেদের রাজত্ব৷ সেই ভারতীয় সংস্থাও কিনা খাসি হয়ে গেল!

স্ট্রাইক মিটল, তবে আবাসিক অংশিদার পাততাড়ি গোটালো, অনাবাসী বড়-শরিকের হাতে লাগাম ছেড়ে দিয়ে৷ যাবার সময় অনেকটা রস নিংড়ে নিল আর টোপ ফেলে গোটা প্রতিষ্ঠানের বাছা বাছা লোকদের নিয়ে গেল নিজেদের প্রতিষ্ঠানে৷ আমি যাইনি; আমার কৈশোরের গোকুল, যৌবনের বৃন্দাবন ছেড়ে কোথায় যাব! …

      কাতলার গাদা ইলিশের কোল
তপসে ভাজা পাবদার ঝোল

                               (দখনে ছড়া)

মাছ শিকারের নেশা ছিল আগে, কিন্তু মাছেভাতে বাঙালি নই, তাই কাৎলা তপসে পাবদার খবর জানিনা৷ ইলিশটা অবশ্যই পছন্দ করি (চিংড়ি কাঁকড়াও, তবে সেগুলো মাছ নয় বলে বোধহয় ছড়ায় পাত্তা পায়নি) এবং নিশ্চিত জানি, শা’গঞ্জ ছিল প্রতিষ্ঠান কুলের ইলিশ (মনে পড়ে, ব্যান্ডেল-হাওড়া লোকালে সেই না-বাউল গায়কের টাটাবাটা**** বড়!) চিবিয়ে ছাতু করে ফেলা ইলিশের কাঁটার মত কোম্পানির ছিবড়েটুকু পড়ে রইলো তারপর৷ প্রতিষ্ঠান চালায় মানুষ; এক আধ জন নয়, অনেকের সমাহারে এক বিশাল মানুষের দল, সর্দার ও পুরোহিত সমেত, সতেরোর ‘ক’ থেকে উনসত্তর ‘ঙ’, যারা যন্ত্রাংশের মত নীরবে নিজের নিজের কাজ করে যায়৷ ঘড়িতে যেমন দম দেওয়া স্প্রিং, প্রতিষ্ঠানের তেমনি দম দেওয়া, জান কবুল করা মানব সম্পদ৷ নীলকণ্ঠের পালক খুঁজে পাওয়া নন্দিনীর মত অলক্ষ্য প্রেরণাও থাকে: একেক জনের একেক রকম — কারু প্রেরণা অর্থ, কারু আবার জিতবার ইচ্ছে, কেউ বা আবার জ্ঞানান্বেষী৷

সেই দম ফুরিয়ে আসা প্রতিষ্ঠানে আমাকে লাথি মেরে আবার ওপরে তুলে দেওয়া হল, প্রথমে শা’গঞ্জের দন্ডমুন্ডের কর্তা, পরে কলকাতার হেড আপিসে, ক্রমক্ষীয়মান রাজত্বের একরাট রাজা!

###

 ১৮পূর্ণ চাঁদের মায়া

ঠিক দুক্কুরবেলা, যখন ভূতে মারে ঢেলা, চারদিক শুনশান, বাবুরা আপিসে,   কাকিমা মাসিমারা নিদ্রালু, দূর থেকে শোনা যেত ডাহুকের নালিশ, প্রেমপাগল কুকুরদের ভৌভৌকার, শিলকাটা ঈশানের ডাক, সাতসতেরো পাখপাখালির হঠাৎ  চেঁচামেচি৷ কর্তৃপক্ষের নিষেধ সত্ত্বেও গ্রাম থেকে ঘাসুড়েরা কাস্তে দিয়ে লনের ঘাস যেমন তেমন কেটে নিত নির্জনতার সুযোগে; যান্ত্রিক ঘাসুড়ের নিপুন ছাঁট সেই টাক পড়া শ্রীহীনতা ঢাকতে পারত না৷ লাফঝাঁপ থেকে নির্বাসিত আমি সান বারান্দায় দাঁড়াতাম এসে, হাতে হয়ত রাজকাহিনী কিংবা সিংখুড়োর গপ্পো, মনটা বাইরের বিস্তারে৷ দেখতাম, রাজ্যের কাক এসে জড়ো হচ্ছে পাশের ব্লকের ছাতে, মিটিং হবে এবার, লোকসভা বিধানসভার মত ভয়ানক চেঁচামেচি৷ বিচার হচ্ছে কোনও গুরুতর আইনভঙ্গকারী বায়সপুঙ্গবের৷ ওদের বিচারব্যবস্থা গণতান্ত্রিক এবং দ্রুত; নিষ্পত্তি হয়ে গেলে তক্ষুনি শাস্তি হয় অপরাধীর —  ঘাতক কাকেরা সাংঘাতিক ঠোকরায় তাকে, অন্যেরা রোমান সার্কাসের হৃদয়হীন দর্শকের মত ছীছিৎকার করে আর ডানা ঝাপটিয়ে ঘাতকদের উৎসাহ দেয়৷

না-হওয়া পাচিলের ওপাশে, সবুজ হলুদ দাবাছক খেতে, পাখমারারা কি যেন বলে চেঁচায়৷…

ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো বর্গি এলো দেশে

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে? …

… জমিদারের খাজনা দেবার সময়ই কি শুধু বর্গি-বুলবুলির অজুহাত? না বোধহয়৷ এস্টেটের বাড়িতে ঢোকার সময় ইয়ংসাহেবের ঢেউখেলানো পাঁচিল সম্পূর্ণ হয়নি; সীমানার ওপারে বিস্তীর্ণ ধান খেত, মুসুর খেত, সর্ষে খেত দেখা যেত, দেখা যেত৷ সেই দিগন্তবিস্তারী সবুজ হলুদ ঢেউয়ের মাঝখানটিতে আম কাঁঠাল বাঁশঝাড় ঘেরা ছোট্ট একটা পটে আঁকা গ্রাম, ছায়াঘন, অসিত হালদারের জলরঙের মত৷ ফসলের সময় রাজ্যের পাখি ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসতো কোথা থেকে, তবে খাজনালোভী বুলবুলিদের দেখেছি বলে মনে পড়েনা৷ পাখমারারাও উদয় হত আকাশ ফুঁড়ে৷

বাংলায় চুয়াড় নামে একটা আদিবাসী জাত আছে, নৃতাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে সাঁওতাল মুন্ডাদের সমগোত্রীয়৷ তাদেরই নামে, আমরা না ভেবে বলি, চোয়াড়ে স্বভাব, চোয়াড়ে চেহারা, চোয়াড়ে ভাষা৷ এদের এক শাখা এই পাখমারা; নামেই পরিচয় — পাখি মারা তাদের পেশা৷ দীর্ঘকাল ধরে চাষি গেরস্তদের ফসল রক্ষা করত তারা; বনবাসী রামের মিত্র গুহর মত কাঁধে ধনুক, তুনীরে তিরের বদলে কোমরে গোঁজা কেঠো মাথার ভোঁতা বাঁটুল, পিঠের ঝুলিতে জাল৷ আর থাকত ভীষণদর্শন মুখ আঁকা কেলে হাঁড়ি — নরম মাটিতে ডাল পুঁতে মাথায় চড়িয়ে দিলেই খাসা কাকতাড়ুয়া! এ ছাড়া ক্যানেস্তারা পেটানোর সরঞ্জাম৷ বাবা বলতেন ওরা নাকি যাযাবর: খেতিকাজের সময় এখানে, বছরের বাকি সময় কোথায় থাকে, কি করে, কে জানে! পাঁচিল উঠে যাবার পরে আর দেখিনি তাদের, তবে বড় হয়ে কেতাবে পড়েছি৷

গোবিন্দ নামের পাখমারাটার বছর পনেরো বয়েস, দীঘল রোগাটে শরীর, খাকি হাপপ্যান্ট আর হলুদ গেঞ্জি পরা ধূসর চেহারা৷ ট্রাইসাইকেল চালাতে দেখে ঝোপ পেরিয়ে এপারে এসে ভাব করেছিল;  তার  মুখটা  এখনও মনে পড়ে৷ বয়েসে আমার চেয়ে বড় হলেও আমাকে ভালো লেগেছিল তার, আমারও তাকে৷ কারণ ছিল৷ আমার তাকে ভালো লাগত তার নাতিবিশাল কিন্তু অন্য দুনিয়ার গল্পের ভান্ডারের জন্য৷ সে চাইত মুখ বদল, একটু স্নেহ, একটু মনোযোগ৷ প্রথম দিনই তাকে দিয়েছিলাম আমার বরাদ্দের অস্ট্রেলিয়ান ক্রাফট চীজ়ের টুকরোটা, তার পর থেকে মঙ্ঘারামের বিশকুট কিংবা কমলালেবু আপেল৷ তাছাড়াও মা তাকে দুধ দিতেন, ঘরে তৈরি কেক দিতেন৷ জঙ্গলে পাওয়া যায় না সেসব, তাই সে আগে কখনও খায়নি৷ বলেছিল, জঙ্গলে আম জাম কাঁঠাল তো আছেই, খেত বাঁচানোর মজুরি স্বরূপ ছালা বোঝাই চাল ডাল নুন আছে, মাটির নাগরিতে জমানো তেল আছে, বন ভরা পাখি খরগোশ সজারু আছে, দিব্যি কেটে যায়৷ “ধ্যাৎ, সজারু খাস কি করে, অত কাঁটা!” সে আমার অজ্ঞতায় মজা পেত: “ছাল ছাড়ালেই সজারু তো খরগোশ, শ্যালের ভয়ে ওরা কাঁটা পরে থাকে, তাও জানিসনা!”

গোবিন্দদের ডাক পড়ত ধান বেড়ে উঠলে, তারপর কাজ ফুরুলে পাজি, যাও, চড়ে খাওগে! কাজ ফুরুলে যে পাজি হয় সে শিক্ষায় আমার সেই হাতেখড়ি; অনেক পরে হাড়ে হাড়ে বুঝেছি৷

আমার সেই স্নিগ্ধ, ছায়াময় আই.ও.কিউ.-এর কাছে এস্টেটের চেষ্টাকৃত শহুরেপনা ফিকে মনে হত বহুকাল৷ কালে কালে সেখানে বাস্তুর সংখ্যা ও বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পেল, প্রায় আকন্ঠ ভরে গেল ইয়ংসাহেবের পূর্বপরিকল্পিত সীমারেখা৷ দু দুটো ক্লাব হল — তার একটায় সুইমিং পুল, স্কোয়াশ কোর্ট, বিলিয়ার্ড ঘর৷ অন্যটায় চেনা স্পোর্টস গ্রাউন্ডের বদলে আনকোরা মাঠ৷ নতুন বাজার, লেডিজ পার্ক, তিন ভাষার তিনটে আলাদা স্কুল৷ তবে সেখানে আমার বহুকালের চেনা সেই জোনাকিদের দেখিনি কখনো, যদিও দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল সর্বদাই৷

সম্প্রতি অনেক দিন জনশূন্য ছিল সেই এস্টেট, ঋগ্বেদের হরিয়ূপীয়ার মত প্রেতপূর্ণ; সারি সারি দরজা জানালা খুঁড়ে নেয়া ফোকলা বাড়ি সব ; লুঠ হয়ে যাওয়া আলো পাখা কল৷ তবে ছিল৷ দু’একবার জি.টি. রোড দিয়ে অন্য কোথাও যাওয়ার সময় দূর থেকে দেখতে পেতাম৷ ইদানীং শুনি নতুন মালিক, হিসেব মিলিয়ে চতুর্থ পক্ষের, সেই সব ইমারত ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে; অথবা হয়ত বিক্ষুব্ধ কিছু মানুষ যাদের প্রতিবাদ মানেই ভাঙচুর, গড়ে তুলতে কেউ শেখায়নি তাদের, তারাই হয়ত আগ বাড়িয়ে অতীত দর্প চূর্ণ করতে চেয়েছে এমন ভাবে যাতে আগামি দিনের কোনও রাখালদাস, কোনও মার্শাল, একটা ইটও খুঁজে না পায়৷ যাতে আবার অক্ষতযোনি কুমারী হয়ে ওঠে গোটা অঞ্চলটা৷ তাকে যথেচ্ছ রমণ করতে উদ্ধত লিঙ্গের মত সারি সারি বহুতল গজিয়ে উঠবে হয়ত সর্বত্র; লোভে চকচক প্রোমোটারের চোখ, লকলকে কামাসক্ত জিভ তাদের!…

সেই জোনাকিদের কম খুঁজেছি নাকি!

ভাইয়ের যখন দশ মাস বয়েস, মায়ের শরীর সারাবার জন্য দার্জিলিং গেলাম সকলে৷ মলের এক প্রান্তে অ্যালিস হোটেলে উঠেছিলাম৷ সুধীদা, সুধীরঞ্জন দাস, সুপ্রিম কোর্টের তদানীন্তন প্রধান বিচারপতি এবং পরে বিশ্বভারতীর উপাচার্য, সস্ত্রীক উঠেছেন ঠিক আমাদের পাশের কামরায়৷ অন্য কোনও কামরায় গৌরী দেবী আর গৌতম, মহানায়কের (তখনও শুধুই নায়ক) স্ত্রী ও আমার প্রায় সমবয়সী তাঁর পুত্র৷ তাঁরা এসেছেন, এবং উইন্ডামেয়ারে না উঠে অনুত্তম   অ্যালিসে  উঠেছেন,  কারণ  গৌতমের  জলবসন্ত৷  স্কুল  কর্তৃপক্ষ  চিঠি  দিয়েছেন একুশ দিনের মত ছেলেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে৷ সেই অন্য কোথাও, অভিভাবকদের বিচারে, কলকাতার স্বগৃহ না হয়ে দার্জিলিঙের হোটেল অ্যালিস ভ়িলা৷ সঙ্গে আছে নায়কের সেক্রেটারি, জনৈক শম্ভু৷ এসব কথা, জানাজানি হবার আগে, গৌতমই বলেছিল আমায়; তখনও তার চুমটি পড়েনি৷ অগত্যা, সুধীদার নির্দেশক্রমে এবং, আমার না হোক, আমার দশমাসের কচি ভাইটার খাতিরে, আমরা সারাদিন যথাসম্ভব বাইরে বাইরে কাটাতাম৷…

তখনও দার্জিলিং এখনকার মত ঘেয়ো, বাক্সসর্বস্ব, ঘিঞ্জি শহর নয় — খোলামেলা মল, স্টেপ-আ-সাইড দিয়ে নেমে গেলে বেহেশতের ঠিকানা৷ সারাদিনের ভাড়া করা টাট্টু নিয়ে, অথবা পদাতিক, আজ এ রাস্তা কাল ও রাস্তা চষে বেড়াতাম৷ সন্ধে বেলা ক্যাপিটলে সিনেমা, ইংরেজি ছবি থাকলে৷ জীবনানন্দের হালভাঙা নাবিকের মত, বাচ্চা নাবিক, বিদিশা শ্রাবস্তী দারুচিনি দ্বীপ দাপিয়ে বেড়াতাম সারাদিন৷ বাবা মা ভাই তখন স্যানাটোরিয়ামে শান্তিনিকেতনের বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছেন৷…

আমার গতিপথে সরল গাছের বন ছিল অনেক, ছায়াঘন, তার ফাঁকে ফাঁকে অনেক সম্ভাবনাময় ঝোপজঙ্গল; খেলনামাপের বাঁশঝাড়; শেওলায় সবুজ পাহাড়ের গা, জ্যান্ত গাছের মাটিতে শুয়ে পড়া গুঁড়ি আর আলগা পাথর; পাহাড়ি ফুল ঝুমকোলতার মত নতমুখ ফুটে থাকত থোকায় থোকায় — সেসব বিচিত্রবর্ণ ফুলের ছবি জল রঙে আঁকলে বিশ্বাস করবে না কেউ! কথায় কথায় উড়ো মেঘ এসে ওড়নায় ঢেকে দিত তাদের অবয়ব৷

এমন জায়গায় খুব মানাত সেই জোনাকিদের, তবু কোত্থাও তাদের দেখিনি!

পুরীর সামুদ্রিক হাওয়ায় জোনাকিরা উড়ে যায়; ঘিঞ্জি গলির অন্ধকারে, হৃদয়হীন পাথরের মন্দিরে তাদের মানায় না৷

কলকাতার বড় রাস্তায় বড্ড বেশি আলো আর নিরালোক গলিঘুঁজিতে দুটো মানুষই পাশাপাশি যেতে পারেনা, কয়েক কোটি জোনাকি তো কোন ছার!

দেওঘরে জোনাকি ছিল অনেক, বম্পাস টাউনের সার সার অবহেলিত দালানকোঠার জঙ্গুলে বাগানে, পেয়ারাতলায়, অস্পৃষ্ট আতা নোনার ফলসম্ভারে, হাস্নাহানা আর যুইঁয়ের সুগন্ধী ঝোপের আড়ালে, কিন্তু বিহারী জুগনু তারা, আমার চেনা কেউ নয়৷

কোথায় খুঁজবো তাদের, কোন নিরুদ্দেশে?

শান্তিনিকেতনে তারা ইচ্ছে হয়ে ছিল মনের মাঝারে, কিন্তু গুরুপল্লি বা শ্রীপল্লিতে নয়, ছেলেবেলাতেও নয়৷ তখন চাকরি করছি কয়েক বছর৷ সুবীর, আমার স্থপতি সুহৃদ, তখন আমার সহকর্মীও৷ লাটবাগানে তার বিভাগের ভাড়া করা ফ্ল্যাট ছিল আমাদের বাড়ি থেকে দু মিনিটের হাঁটা পথ, তবু আমাদের সঙ্গেই তার থাকা নাওয়া খাওয়া৷ আমার আত্মীয়েরা, পারিবারিক ও বিবিধ বন্ধুরা, তারও খুব পরিচিত হয়ে গেছে তত দিনে৷ এক সঙ্গে দিল্লি বেড়াতে গিয়ে আমার এক আত্মীয়ের বাড়ি উঠেছিলাম একবার, এবং তাঁদের যথেচ্ছ জ্বালিয়েছিলাম তিনজনেই (সঙ্গে টুকুও ছিল), নির্দ্বিধায়, নিঃসংকোচে৷ অসাধারণ মেধাবী ছিল সুবীর; অধীত বিদ্যা ছাড়াও যান্ত্রিক বৈদ্যুতিক বৈদ্যুতিন কারিগরিতে; হাতে গড়া মডেল বিমানের বেতার উড়ানে;  প্রাচীন,  ফেলে দেওয়া,  ডগলাস মোটরসাইকেল দুশো টাকায় কিনে, তিন মাসের মধ্যে স্বহস্তে সারিয়ে তুলে, স্টেটসম্যানের ভ়িন্টাজ কার প্রদর্শনীতে যোগ দেওয়ার প্রকল্পে; দুনিয়ার কল্পবিজ্ঞানের গল্পে তার জুড়ি মেলা দায়৷…কারখানায় দোল হোলি মিলিয়ে দুদিন ছুটি থাকত৷ সত্তরের দশকের শুরুর দিকে একবার তার মোটরসাইকেলে (ডগলাসের চেয়ে তরুণতর অন্য এক দেশি মডেল) হঠাৎ, উঠলো বাই, তো শান্তিনিকেতন চলে গেলাম দুজন, দোলের আগের দিন বিকেলে৷ উঠলাম দাদির শ্রীপল্লির বাড়িতে, অনাহুত, কিন্তু পরম আদরে ডেকে নিয়েছিলেন দাদি তাঁর স্বভাবসুলভ স্নেহে৷

পরদিন দেখি খোল দ্বার খোলএর মিছিলে নন্দিতা এবং দর্শকের ভূমিকায় আমার কলকাতার বন্ধুবান্ধব বেশ কয়েকজন৷ নন্দিতা আছে মানে, দেখা না গেলেও, অতীনও আছে কোথাও৷ তখনও দোলের শান্তিনিকেতনে যারা যেত তারা সম্পর্কের টানেই যেত, যেত ভালোলাগা আর পরিচয়ের নেশায়, গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজার পাঁচমাথার মতলবি হুল্লোড় সঙ্গে বয়ে নিয়ে যেতনা৷ অমিতাদি বললেন, “মাকে এত জ্বালাস তোরা! দুপুরে তো বাড়িতে খাবি না, জানি, রাতে আমার ওখানে খাস৷” ভালোই হল, কারণ আমার সমবয়েসী চেনা স্থানীয়দের দেখা পাইনি সেবার, তাই অমিতাদির প্রস্তাবে বিনা ওজরে রাজি হয়েছিলাম৷

অবেলায় কালো করে এসেছিল আকাশ; হবি তো হ, পরিক্রমা শেষ হতে না হতে ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি নামল, ফাল্গুনেই কালবৈশাখী৷ বৃষ্টি ধরতেই অতীন বলল, “চ, কোপাই দেখবি চ”৷ দল বেঁধে গিয়ে দেখি, রক্তের নদী বইছে — সে দৃশ্য আগে কখনো ঠাহর করে দেখিনি, সে ভাবে দেখার মনটাই তৈরি হয়নি হয়ত৷ সাধে কি আনন্দ বাগচী তাঁর কবিতায় আলতার শিশি ভাঙলো, কোপাই কি শান্তিনিকেতনে লিখেছিলেন! অমিতাদির বাড়ি ডিনার মানে কাঁটায় কাঁটায় আটটা, তাই ঠিক হল ছটার সময় মিলব সবাই চৈতির সামনে৷

সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে অমিতাদির বাড়ির উলটোদিকের খোয়াই, শ্রীপল্লির রাস্তার ওপাশে৷ এখন সেখানে বিস্তর দোকান, আপিসঘর, নির্জনতা কেড়ে নিয়েছে; তখন একটা বাদে আর কোনো বাড়িও ছিল না৷ কাঁকুড়ে মাটিতে গোল হয়ে বসলাম সবাই, তৃষিত মাটি তখন বৃষ্টির সব জল নিঃশেষে শুষে নিয়েছে৷ অর্জুন গলা ছেড়ে আশায় আশায় ভালবাসায়, তোমার নাকি বিয়ে হবে গাইল, আমরা হাততালি দিয়ে হাসলাম সবাই; তারপর এ কথা সে কথা, এ গান সে গানের পর নয়নিকা বলে একটি মেয়ে, আগে কখনও দেখিনি তাকে, পরেও নয়, পূর্ণ চাঁদের মায়ায়  গাইল অসামান্য তৈরি গলায়৷ সে দেখতে কেমন, কি তার পরিচয়, এসব ভাবিনি৷ কন্ঠ দিয়ে সে একটা মায়ার জাল, পূর্ণ চাঁদের মায়ার জাল, বুনেছিল — যে চাঁদটা তখন স্নাত আকাশে একটা সরল প্রতীকের মত জ্বলজ্বল করছে; যে চাঁদ পূর্ণ হলেও আশৈশব আমি বলতাম পুরনো চাঁদ, চির চেনা, তবু নতুন চাঁদ, ফি-পূর্নিমায় নতুন করে ওঠে, জলে ধোয়া বসন্ত পূর্নিমায় আরো নতুন যেন! কোপাই তখন অনেক দূরে, দৃষ্টির আড়ালে, কিন্তু কল্পনায় তার রাঙা জলের ছলাৎছল শুনতে পাচ্ছিলাম৷ সেই মায়া, চাঁদের আলো আর সুরের মূর্চ্ছনা মাখা সন্ধ্যায় আসা উচিত ছিল তাদের, তবু সেই জোনাকিরা আসেনি৷

###

১৯ যা হারিয়ে যায়

সে যে ছড়া আছে না,

এক পয়সার তৈল

কিসে খরচ হইল?

তোর দাড়ি, মোর পায়ে

আরো দিছি ছেলের গায়ে।

ছেলেমেয়ের বিয়া হলো,

সাত রাত্তির গাওনা হলো।

কোন আবাগি ঘরে এলো

বাকি তেলটুক ঢেলে নিল?

… জীবনের বারো-চোদ্দ আনা খরচ করে ফেলে আজ আমি বাকি তেল টুকুর খোঁজ করছি! তেল তো তরল: উবে যায়, গড়িয়ে যায়, দাহ্য বলে পুড়েও যায়। নসিবের বা বহিরাগত আবাগিদের দোষ দিয়ে লাভ কি! তাছাড়া নসিব যেন গনৎকারের ধামাধরা!

আরও একটা আপ্তবাক্য আমাকে বিষম ধন্ধে ফেলে। চিত্তকাকার ছেলেবেলায় দেখা এক বরিশাইল্যা পাগল নাকি অন্যদের একটু বেচাল দেখলে বলত, “যত সব পাগলের বাসা, কলা খায় ছুইল্যা!” (চ-বর্গের পূর্বী ঢঙের দন্ত্য উচ্চারণ আর মহাপ্রাণের গিলে ফেলা হ বাংলা লিপিতে ফোটানো শ্রমসাপেক্ষ; কাজটা পাঠকের মর্জির ওপর ছাড়া রইলো।) আমিও দেখি, চারদিকের বিষয়ী সংসারী সফল যত মানুষ গোমড়ামুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কলাও খাচ্ছে ছুলে! তারা পাগল নয়তো কি?

হয়ত এককালে তাদের কেউ কেউ আমার খেলুড়ে ছিল, ছেলেবেলাটা বেদম হাসি আর পরিমিত কান্নার মধ্যে বড় হয়েছি সব, হয়ত অজান্তেই ভেবেছি তেমনি করেই দিন যাবে। আমি চেষ্টা করে হাসিটুকু বাঁচিয়ে রেখেছি, ঠিক; আমার সহখেলুড়েরা অনেকেই দরকারের চেয়ে বেশি সিরিয়াস হয়ে গেছে — এতটাই গম্ভীর যে আরেকটু হলেই বিবর্তনের পথে পিছু হঠতে হঠতে গোরিলা পর্যায়ে পৌঁছে যেত। তাদের কেউ কেউ ধর্ম খুঁজে পেয়েছে কেউবা অধর্ম; ভাগ্যগণনা রত্নধারণ পূজাপাঠ ইত্যাদিতে অগাধ বিশ্বাস তাদের। দুয়েকজনকে প্রশ্ন করে দেখেছি; তারা সোজাসুজি উত্তর দেয়নি তবে শরীরী ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রশ্নটা তাদের মনঃপুত নয়। আবার সেই চিত্তকাকা কথিত একটা মাহিলারার রোম্যান্টিক যাত্রার ডায়ালগের মত: নায়ক জিজ্ঞেস করলো, “জানালার পাশে একাকী বসি কি ভাবিছ রাজবালা?” নায়িকার ভঙ্গিমুখর উত্তর, “মরি এ কোন জ্বালা, এ কোন জ্বালা!”

সে যাকগে, আমি তো কলাই খাইনা, তার ছোলা না আছোলা! অর্থাৎ আমাকে পাগল প্রতিপন্ন করা শক্ত হবে।…

আগে এক সময়ে অ্যাভ়রো ৭৪৮ বিমানের অনেক উড়ান ছিল দক্ষিণ ও পশ্চিম উপকূলে, লাফানে উড়ান,  দুই  বা  তিন  লাফে গন্তব্যে পৌঁছোত৷ তেমনই  একটা  উড়ানে  মাদ্রাজ  থেকে ব্যাঙ্গালোর কিংবা কোচিন যাচ্ছি একবার — সম্ভবত তিরুপতি ছুঁয়ে৷ তড়িঘড়ি উঠেছি বলে নম্বরহীন আসনমালার ডানদিকের শেষ লাইনে জানালার সীট পেয়ে গেছি, অন্যটা খালি৷ ব্রীফ়কেসটা রেখেছি সেখানে৷ সে বয়েসে অবশ্যই আশা করতাম কোনও সুন্দরী সেই খালি আসনটা দখল করবেন হয়ত, কিন্তু মধ্যপথে উঠলেন এক দক্ষিণী ভদ্রলোক, মাঝবয়সী; আমাকেও বিরক্তিভরে বাক্স কোলে নিতে হল৷ বিমান ছাড়তে না ছাড়তে ভাব জমাতে শুরু করলেন৷

তিনি নাকি দেবরাজ অর্সের পোষা গণৎকার এবং, তাঁর গণনায়, অর্স অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী হবেন অদূর ভবিষ্যতে! আমার কার্ড চাইলেন৷ তারপর শুরু হল আমার নামের অক্ষরগুলো দিয়ে নিউমেরোলজির ব্যাখ্যান৷ সাতকেলে অবিশ্বাসী সেই আমাকেই শোনাচ্ছে ভূত ভবিষ্যতের সাতকাহন! অতীতের দশটা কথা বললে, কে না জানে, চার পাঁচটা মিলবেই৷ “তোমার জীবনে একটা বড় আঘাত এসেছিল কৈশোরে”…পিতৃবিয়োগ, এটা কাকতালীয় কিন্তু সত্যি৷ “অল্প  বয়েসে খুব বড় চাকরি কর তুমি”…আমার কার্ডেই তার হদিস৷ কিছুর মধ্যে কিছু নেই, হঠাৎ বললেন, “আরো বড় আঘাতের জন্য তৈরি থেকো, পঞ্চাশের কাছাকাছি, প্লাস মাইনাস তিন!” এটা মোক্ষম এবং মজাদার ভবিষ্যৎবাণী, তায় আবার হবু প্রধানমন্ত্রীর খোদ গণকের মুখনিঃসৃত, স্বকর্ণে শুনেছি বলেই — এবং অর্স যেহেতু প্রধানমন্ত্রী হননি — মনে ছিল৷ হাড়ে হাড়ে তার যাথার্থ্য টের পেয়েছি অনেক পরে ৷

জটিল রাবারের অণু বিস্তর ঘেঁটেছি; দরকার মত নির্দ্বিধায় ম্যানিপুলেট করা যেত তাদের, রামের সঙ্গে রহিমের ভাগ্য মিলিয়ে দিয়ে অচিন্ত্য নতুন গুণাবলী আরোপ করেছি অনায়াসে৷ মানুষ জাতটা রাবারের অণুর চেয়ে, আগেই জানতাম, অনেক অনেক বেশি জটিল, তবে অঙ্কের না হোক সমাজতত্ত্বের নিয়ম তো মানে! কিন্তু কর্মীদের যারা অঙ্গুলিহেলনে চালায়, সেই মালিকপক্ষ ও তার সাক্ষাৎ প্রতিনিধিরা, এই অধমও যার বাইরে নই, তারা সেই পাঁচ হাজার মানুষের চেয়েও বেশি জটিল, ডি.এন.এ.’র জোড়া ইশক্রুপের প্যাঁচের ওপর কয়েক গুণ! চড়াইয়ের রাস্তায় শত্রুর সংখ্যা বাড়ে, তাও জানতাম৷ যাদের উপকার করেছি তারাই যে বেশি শত্রু হয় তাও, বিদ্যেসাগর মশায়ের দৌলতে, অজানা নয়৷ তবে চেনা মানুষ, কাছের মানুষও যে কোথায় নামতে পারে তা বুঝিনি মোটেই৷ নিউমেরোলজিস্টের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম কিন্তু ১৯৯৩এর শেষের দিকে, যখন আমার বয়েস সাতচল্লিশ, বিরোধীদের চাপে এবং বৃহত্তর দায়িত্বের নামে, নবকলেবর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ — রণাঙ্গনে যাঁদের দেখা দায় কিন্তু হোমারের গ্রীক দেবতাদের মত মরণশীল মানুষের বাঁচামরা যাঁদের হাতে — রাতারাতি কলকাতায় বদলি করলেন আমায়, নেইসাম্রাজ্যের এক্কা গাড়ির ঠুলি আঁটা ঘোড়াটার ভূমিকায়৷ হেড আপিসে ঠাইঁ হল একতলার টয়লেটের পাশের ঘরটায়, যেটা আগে ছিল কোম্পানি সেক্রেটারির কাগজপত্রের গুদাম৷ সেখান থেকে অবশ্য বাহুবলে সর্বোচ্চ তলার একটা ঘর দখল করেছিলাম আবার৷ সেসব ব্যাখ্যান নয়, আঘাতের ব্যাপারটা বোঝানো দরকার এখানে৷

সেই জোনাকিদের থেকে বহু দুরের একটা হাঁপিয়ে ওঠা, রং চটা, যক্ষাগ্রস্ত শহরে নির্বাসন আমার মত লোকের কাছে দ্বীপান্তরের চেয়েও বৃহত্তর আঘাত৷ ১৯৯৪-এর শেষের দিকে মুক্তির দরখাস্ত দিলাম, ১৯৯৫এর ফেব্রুয়ারিতে একতৃতীয়াংশ বেতনে যোগ দিলাম অন্যত্র৷ তারপর আর কারখানার চৌহদ্দির ছায়া মাড়াইনি কখনো৷

যতই নির্লিপ্ত হই, খেদ থেকে যায়৷

পঞ্চিপিসির খোঁজ করিনি আর৷ আমার এলেবেলে স্কুলের এক সুন্দরী, বড় হয়ে বিমান বালিকা হয়েছিল; একটা উড়ানে তার ফোন নম্বর দিয়েছিল পুরনো দিনের খাতিরে৷ যোগাযোগ করিনি৷ সুভাষ কুলকার্নির সঙ্গেও আলাপটা ঝালাইনি৷ সে সবই আমার দোষ, মানি৷ চুয়াড় জাতির প্রতিভূ, গোবিন্দ, সেই এক ফসলের পর আর আসেনি৷ ঘরে তৈরি রাজাভোগ, পান্তুগোল্লা  খাবার নিমন্ত্রণ করে ফটিকবাবু চিরকালের জন্য চলে গেলেন৷ আলতার শিশি ভাঙা খোয়াইয়ের পূর্ণিমায় নয়নিকা আর কোনও দিন গান শোনালোনা৷ সুবীরের সঙ্গে নতুন করে যোগাযোগ হয়েছিল ইদানীং — সেটা দেখাসাক্ষাতে পরিণত হওয়ার আগেই সে তড়িঘড়ি চলে গেল নিরুদ্দেশে, তর সইলনা৷ সেই জোনাকিরা যে ফিরে এলোনা আর, সেসবও কি আমার দোষ?

আসলে সারা বেলা হেলা ফেলা দেখে কোন আবাগি যেন আমার অজান্তেই বাকি তেলটুকু ঢেলে নিয়ে গেছে; ভারি তো এক পয়সার তৈল!

শেষ

Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>





সেই জোনাকিরা (১৩–১৫) ৷৷ অনিরুদ্ধ সেন

3 05 2013

There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the fifth.

১৩ বন কেটে বসত

আমার স্কুল জীবন শুরু হয়েছিল উনিশ শো একান্নর গোড়ায়; বারো নম্বরের পেছবাগান তখন নানান মরশুমি ফুলে ঝলমল করছে৷ চার বছর পুরে সবে দুমাস হয়ছে৷ চেনাদের মধ্যে এ পাড়ার ননতু, হেদর, ক্যারল, হাসি৷ তা ছাড়া বেপাড়ার সুজিত, বাপি আর আর ইলাকে আগেই চিনতাম৷ অন্যেরা সব আনকোরা৷ যে রাস্তায় আমার ট্রাইসাইকেল অ্যাডভেঞ্চর, স্কুলগামী   রিকশা  সে  পথ দিয়ে আরো  অনেক দূর,  বাজারের  পাশে  বাগদিপাড়া  রোড  হয়ে, কারখানার পাচিল ডানহাতে রেখে চলছি তো চলছিই…হঠাৎ একটা বাঁক নিলে কারখানার প্রধান ফাটক, তারপর ডাইনে ঘুরে ময়দান আর ক্লাব হাউস, তারও পর স্কুল৷ কম রাস্তা? একেক পিঠে প্রায় সিকি ঘন্টা! কারখানার ভেতর দিয়ে গেলে সময় বাঁচে অনেক কিন্তু বিধি, অর্থাৎ আমার পিতৃদেব, বাম; “আমার ছেলেকে আনডিউ অ্যাডভ়ান্টেজ নিতে দেবনা!”

এলোপাথারি ম্যাকিউলার ডিজেনারেশনের মত এখন আমার স্মৃতিপটের অনেকটাই পোকায় খাওয়া, নাম ভুলে যাই, মুখের সঙ্গে নাম মেলাতে পারিনা, আগে পরে পারম্পর্যে বিস্তর গোলমাল৷ তবু যেন মনে হচ্ছে, হেদর আর ক্যারল ছিল আমার প্রথম রিকশা সহযাত্রী, পরে তাদের বদলে ননতু৷ আনটি ডি’ক্রুজের স্বামী ছিলেন, পরে জেনেছি, কোম্পানির ওয়ার্ক স্টাডি বিশেষজ্ঞ, থাকতেন ক্লাব হাউস পেরিয়ে বাঁহাতি রাস্তায়, যার দুপাশে সার সার স্টাফ় কোয়ার্টার নতুন ধোবিখানা অবধি (তখনও তৈরি হয়নি)৷ পোর্টুগীজ় গোয়ার এই তরুণ দম্পতি ছিলেন অতিশয় ভদ্রলোক; তাঁদের প্রথম সন্তান, ব্রেন্ডা, তখন সবে হয়েছে, তাকে প্র্যামে শুইয়ে স্কুল চালাতেন আন্টি, গোড়ার দিকে তাঁকে সাহায্য করতেন তাঁর মা — তাঁকে আমরা টীচর বলতাম৷ বি ব্রেন্ডার চুষিকাঠি মুখে দিয়েছিল একদিন, ননতু অমনি নালিশ করলো, “আন্টি! আন্টি! বি ব্রেন্ডা মিল্ক!” বুঝতে অসুবিধে হয়নি কারু৷

যখন এই অবাক দুনিয়ার সিংদরোজা আমার চোখের সামনে ধীরে ধীরে খুলছে, ছুটি পড়লেই বরং কেঁদে কেটে অস্থির, ঠিক তখনই ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়ার মত একটা বাজে অসুখ ধরলো আমার! তার একটাই সুফল — সপ্তাহাধিক কাল, হয়তো দ্বিসপ্তাহাধিক, মায়ের সঙ্গে শোওয়া, সেখানে তাঁর স্নানশেষের উষসী পাউডারের সুবাস, হেজ়েল স্নো, ওটিন ক্রীম, অগুরু সেন্ট৷ বাইরে যেতে গেলে অবশ্য বিলিতি কমপ্যাক্ট আর সন্তর্পণে খরচ করা শ্যানেল ফ়াইভ়৷ তোয়ালে জড়িয়ে মা আমার মাথায় আইস ব্যাগ দিচ্ছিলেন একদিন, পাশে দাঁড়িয়ে ঊষা কাকিমা, দরজার কাছে উৎকন্ঠিত বাবা — এই দৃশ্যটা মনে আছে আমার৷

বছর তিনেক পড়েছি কি পড়িনি, নতুন ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ভাব হয়েছে: রতন সেনগুপ্ত, নাম করা ভালো ছেলে; আমি পড়া না পারলে মাকে বলতাম, “আমিও পড়া পারিনি, রতনও পড়া পারেনি!” কলেজ শেষ করেই সেই যে গেল, অ্যামেরিকাতেই পাকাপাকি থাকে সে; অধুনা ই-মেলেই যেটুকু যোগাযোগ৷ ইলা চোংকার; তিন বোন তারা — শীলা, ইলা আর নীলা৷ দিদি শীলা পরে একবার ইভ়জ়’ উইকলির ভারত সুন্দরী হয়েছিল৷ গৌতম, ফোটোগ্র্যাফ়ার অমর সেনের ছেলে, সে বোধহয় কিছুকাল থাকত চোংকারদের সঙ্গে; কলকাতার সাকিন ছিল লেক মার্কেটের কাছে৷ আর্কিটেক্ট ইয়ং সাহেবের ছেলে, জনি, যে দেশে ফিরে গিয়ে পরে ইশকুল মাস্টার হয়েছিল; ছুটিতে শা’গঞ্জে এসেছিল একবার, দেখা হয়নি আমার সঙ্গে৷ কলিন বাটারউইক — চোখে মুখে কথা বলত, চ্যাটারবক্স৷ ক্ষণস্থায়ী সুভাষ কুলকার্নি — লিখতে বসে হঠাৎ মনে পড়ল নামটা৷ সে কে, কোত্থেকে এলো, কোথায় গেল, কিচ্ছুটি মনে নেই, শুধু মনে আছে ভালো লেগেছিল তাকে৷ আরো কত কে!

এমন  সময়  বিনা  মেঘে কামলায়  ধরল আমাকে,  বিলিরুবিন  বলে কি একটা যেন নাকি তুঙ্গে, চোখ-চামড়া-নোখ সেই টিয়াপসন্দ সূর্যমুখীর মত, কেঁদো বাঘের মত হলুদ — শার্দুল শার্দুল উজ্জ্বল জ্বলছে!

ইত্যবসরে বড়রা তাঁদের অভিরুচি মত নতুন এস্টেটে স্থানান্তরণের বন্দোবস্ত করছিলেন, আলোচনা শুনেছিলাম আগেই৷ আমার স্কুলে যাবার যে পথ কারখানার প্রধান ফাটক থেকে ডাইনে বেঁকেছে, সেটাই মিলেছে ফাটক থেকে নাক বরাবর এক কিলোমিটর গিয়ে জি.টি. রোডের সঙ্গে৷ রাস্তাটা আগেও ছিল, তবে ইয়ং সাহেব ভেবেচিন্তে চওড়া করেছেন সেটা, আর তার নামকরণ হয়েছে লিঙ্ক রোড৷ জি.টি. রোড যেতে তার বাঁ দিকটা ফাঁকাই বলা যায়, কিছুটা জল কিছুটা ডাঙা, বাদা আসলে, দুএকটা বোর ওয়েলের ইটের ঘর৷ ডানদিকটায় প্রথম সারিতেই অনেকগুলো দোতলা, পয়েন্টিং করা ইটের বাড়ি, ঝকঝকে নতুন হাসপাতাল, নতুন টেনিস এন্ড সোশল ক্লাব৷ আরো ভেতরের সারিগুলোর জায়গায় জায়গায় অ্যাটাচড একতলা স্টাফ় কোয়ার্টার সব, আর অপারেটরস’ ফ়্যামিলি কোয়ার্টার, লাইনের পর লাইন৷ প্রথম সারির বাড়িগুলোর সব কটাই তখন জোড়ুয়া ভাইয়ের মত সমদর্শন—প্রতি তলায় দুটো করে ফ্ল্যাট; শুধু হাসপাতাল থেকে স্কাউটস’ ডেন অবধি পাঁচটা বাড়ির প্রতিটি ফ্ল্যাটে একটা করে বাড়তি সান বারান্দা — শীতকাল ছাড়া রোদ পোয়ানোর দরকার এমনিতে নেই কিন্তু এই দক্ষিণমুখী জালে ঢাকা বারান্দাটা হাওয়া ঘরের মত, আবার ঘোর বর্ষায় দরকার মত কাপড় শুকোত অনেকে৷ বাবা বলতেন, “ঘরের জাঙিয়া ঘরেই থাক না!” বস্তুত, পেছনের নির্জাল লম্বা বারান্দাতেও লোক না দেখিয়ে স্বচ্ছন্দে কাপড় শুকোনো যেত৷ আমাদেরটা ছিল স্কাউটস’ ডেনের আগে উন-অন্তিম বাড়ির দোতলায় ১১৬ নম্বর ফ্ল্যাট৷

###

১৪ পদ্মখাকির দল

শা’গঞ্জের নামকরণ হয়েছিল বাংলা বিহার ওড়িশার মুঘল শাসক শাহ আজ়িমের নামে, যাঁর পোশাকি নাম আজ়িম উশ শান৷ প্ৰথম বাহাদুর শাহের ছেলে তিনি, ঔরঙ্গজ়েবের নাতি৷ কোনো যুদ্ধে একদা শিবির ফেলেছিলেন এই তল্লাটে৷ তার আগেও বর্ধিষ্ণু ছিল গ্রামটা, বাঁশবেড়ের মতই সাবেক সাতগাঁর এক গাঁ, তবে আগে তার কি নাম ছিল তা নিয়ে অনেক সংশয়৷ সরস্বতী মজে যেতেই সাতগাঁর হাঁড়ির হাল৷ বর্ধিষ্ণু বেনেরা মালকড়ির খোঁজে সাতগাঁ ছেড়ে চাটগাঁ (তৎকালীন পোর্টুগীজ় বানানেও প্রায় একাকার নাম দুটো, Catgao আর Catigao), ঢাকা, মালদা, মুর্শিদাবাদ, মায় কলকাতায় ছড়িয়ে গেল৷ চতুষ্পাঠী টোলগুলো তার পরের শিকার: এক বাঁশবেড়েতেই অনতিঅতীত একদা চল্লিশ ঘর টুলো উপাধ্যায় ছিল বলে কানাঘুষো৷ ইংরেজ আমলে আজ়িমের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল পাবলিক; সেই সুযোগে জায়গাটার নাম হয়ে যায় সাহাগঞ্জ — কয়েক ঘর স্থানীয় সাহা যারা ছিল তারা সে’নামের দাবি রাখেনি কখনও৷ বিভূতিভূষণ তাঁর দেবযান উপন্যাসে শা’গঞ্জই লিখেছেন — শা’গঞ্জ-কেওটা — কেওটা মানে কেওট (কৈবর্ত) পাড়া৷ তা লিখতেই পারেন, একদা কিছুদিন এ তল্লাটে ছিলেন তিনি, অপুর কিশোর বয়েসে; প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের পাঠশালা নাকি এখানেই ছিল!

সেনাশিবিরের দৌলতে শা’গঞ্জ বাঁশবেড়ের সঙ্গমে, যার নাম এখন খামারপাড়া, গড়ে উঠেছিল একটা অবধারিত বেশ্যালয়৷ সৈনিক আর বেশ্যা, দেবসেনাপতি উভয়েরই আরাধ্য৷ সেই সুবাদে, পাঁজি দেখে নয়, কৃত্তিকা নক্ষত্রের নামে যে কার্ত্তিক মাস, তার শেষ দিনে এখনও ধুমধাম করে হয় কার্ত্তিকেয়ের পূজা, বারোয়ারি উদ্যোগে৷ তাও একটা দুটো নয়, গণনাতীত! কাত্তিক ঠাকুরের চেহারার রকমফের দেখে ধাঁধা লেগে যায়: খোকা কাত্তিক, ধেড়ে কাত্তিক, দরওয়ান কাত্তিক, এক কানে দুল পরা ঢলানে কাত্তিক (সম্ভবত গে!), বরাঙ্গনা বারাঙ্গনা পরিবৃত লম্বা জুলপি কানে মাকড়ি হাতে লোহার বালা কোমরে ভোজালি মাচো কাত্তিক, এবং দেবানন্দ ব্রুস লী মার্কা কাত্তিকও দেখেছি৷ এখন হুজুগটা হুগলি চুঁচড়ো এবং বাকি বাংলায় ছড়িয়ে গেছে৷ আর আলকাৎরায় লেখা গৃহস্থের বাড়ি নামাঙ্কের সন্দেহজনক পাড়াটা আমার স্মরণকালেও ছিল — সে পাড়ার সত্যিকারের গেরস্তরা গোরে মালা হাতে, আতর সুরভিত, প্রায়-মাতাল রসিকদের হাত থেকে পরিবারের মহিলাদের রক্ষার্থে বাড়িময় লিখে রাখতেন তাঁদের শুচিতার বিজ্ঞাপন!

বারো কোয়ার্টারের অবস্থান শা’গঞ্জের উত্তর-পূর্ব কিনারায়৷ গেট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে ডানদিকে কিছুটা গেলে কারখানার ফাটক৷ বাঁদিকে খামারপাড়া, প্যালেস বোর্ডিং, তার উল্টোদিকে গন্ধেশ্বরী ঘাট৷ সেসব উজিয়ে বাঁশবেড়ে৷ বাঁশবেড়ের ওবাগে দেবরায়দের বাসুদেব (প্রাচীন) আর হংসেশ্বরীর (অর্বাচীন) মন্দির৷ মন্দিরের আশেপাশের ময়রারা খাসা মাখা-সন্দেশ বানাতো, দানা দানা; তেমনটি আর খেলামনা!

তারপর, দরাপ খাঁ গাজির ঢিপি পেরিয়ে, ত্রিবেণী৷ সেই খাঁসায়েব — তুর্কি জ়াফর খাঁ গাজ়ি (ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতক) — যিনি শেষ জীবনে ভুলভাল সংস্কৃতে গঙ্গাস্তোত্র লিখতেন: সুরধুনি মুনিকন্যে…  জাতধম্মের অত্যাচার চরমে পৌঁছনোর আগে অবশ্যই সম্ভব ছিল সেটা, আজ হলে এম.এফ়.হুসেনের দশা হত, অন্যথায় মৌলবিদের রক্তচক্ষু, হয়ত দুটোই! বাঁশবেড়ের মাঠে রথের মেলা বসত তখন: থালার মত বড় পাঁপড়ভাজা আর দাঁতভাঙা গুজিয়া-কটকটি (বাসি সন্দেশ বেশি করে চিনিতে জ্বাল দিয়ে আধ বিঘৎটাক লম্বা কাঠির মত গড়ে একটু তিল ছিটিয়ে তৈরি হত দাঁত ভাঙা কটকটি) খেয়ে, চাকাওয়ালা মালসার ওপর ব্যাঙের চামড়া লাগানো দড়িটানা খ্যাঁচকাঠির ট্যামটেমি, কিংবা টিনের চোঙের দুপাশে নকল চামড়া আঁটা ঢোল, এবং বাঁশের-কাঠির-ওপর সাঁটা মৃগিগ্রস্ত তালপাতার সেপাই কিনে বীরদর্পে ঘরে ফিরতাম৷

আমাদের বারো নম্বর বাড়িতে সোফা সেটি; সেন্টার টেবিল; পেক্স স্টুল; দম দেয়া বাক্স গ্রামোফোন (রেড উডের বডি, সবচেয়ে ওপরের প্রকোষ্ঠের হিঞ্জ করা ডালাটা ষাট ডিগ্রি কোণ করে খুলত — ডালার মাঝখানে প্রভুর বশংবদ সারমেয়ের ছবি, টার্ন টেবলের এক পাশে পিন রাখার আর বাতিল পিন ফেলার জায়গা, অন্য পাশে ষোলো থেকে আটাত্তর আর.পি.এম. অব্দি ঘূর্ণি পাল্টানোর ডায়াল, বাক্সের তিনটে প্রকোষ্ঠের মাঝেরটায় চোঙ্গার বদলে একটা তসরে ঢাকা চৌকো অংশ — বাবার ভাষায় গ্লাস-ডায়াফ়্রাম স্পিকার — সেটা যে কি জন্তু তা কে জানে! নিম্নতম প্রকোষ্ঠে রেকর্ড রাখার ব্যবস্থা); মায় আমার চেন-স্প্রকেট ওয়ালা বিলিতি ট্রাইসাইকেল — সবই ছিল, জীবনানন্দের অমোঘ ভাষায়, ব্যবহৃত, ব্যবহৃত, ব্যবহৃত…, বিদায়ী সাহেবদের থেকে কেনা৷ শুধু আমার দুলুনি ঘোড়াটা আনকোরা; অবরেসবরে সেই ঘোড়ায় পালা করে দুলত সবাই, সমবয়স্ক কারু জন্মদিনে গমগমে আওয়াজের সেই বাক্স-গ্রামোফোনটার চাহিদা ছিল খুব — বিবিধ ঈর্ষান্বিত মন্তব্য (বাট নট সো পোর্টেবল লাইক আওয়ার অ্যাটাচি-সাইজ়়ড ওয়ানস!) সত্ত্বেও৷

বারো কোয়ার্টারের চত্তরে বারোটা একতলা বাড়ি, মেলাই ছেলেমেয়ে, তার মধ্যে আমার কাছাকাছি বয়েসের বিজগুড়িরা আধ ডজনের বেশি তো বটেই! আমরা ক’জন আন্টি ডি’ক্রুজ়ের এলেবেলে স্কুলে যেতাম শম্ভুর মাসকাবারি রিকশায়৷ মাঝেমাঝে পাগলা সুন্দরলাল তার বদলি খাটত৷ (সুন্দরলাল সত্যিই পাগলা: শরৎ সরণির অন্ধকারে হিসি করতে নেমে ডানহাতে সাপের ছোবল খেয়েছিল; বাঁহাতে বিষাক্ত সাপটার ফনা মুঠিয়ে ধরে, রিকশা চালিয়ে, সোজা কোম্পানির হাসপাতাল!) অন্যেরা যেত কোম্পানির বাংলা স্কুলে, পঞ্চিপিসির সঙ্গে, পদাতিক৷ পঞ্চিপিসির ছেলেছাঁট চুল ও পরনের কাপড় দুইই সাদা৷ ছোটখাটো মানুষটা ঝুঁকে পড়লেও শক্তপোক্ত৷ প্রত্যেকটি ক্লাস ঝাড়পোছ, হেডমাস্টারের নোটিস এ ক্লাস ও ক্লাসে চালাচালি আর সময়মত ঘন্টা বাজানো ছিল তার কাজ; পরীক্ষার সময়ে ওপর টেইম!

খোলা আকাশের নিচে, সবুজ-দেয়াল সবুজ-গালিচার খেলাঘরে, বেমিশাল আনন্দ ছিল তখন: স্বাধীনতার আনন্দ, বড়বেলায় যার খোঁজ পাইনি আর৷ রঙন ফুলের মধু চুষতাম আমরা, বড়কাকিমাদের লংকা জবারও৷ মৃত্যুঞ্জয় মুখার্জির যমজ মেয়েরা, বড়ি আর ছুটি, বলত, “কলকে ফুলের মধু খাসনি, বেজায় বিষ!” আমরা তাও চুষতাম৷ হাঁটুতে মার্কিউরোক্রোম, কনুয়ে মার্কিউরোক্রোম, কখনও সখনও লাল ওষুধের বদলে গাঁদা পাতার হাতে ডলা রস, কারুকারু কপালে স্টিকিং প্লাস্টার (ব্যান্ড-এড তখনও দেখিনি), আলুথালু চুল, প্যান্টের বাইরে শার্টের লেজ, ধুলোমাটি মাখা তো ছিলই!

সে সব ছেড়ে যাওয়া সহজ?

তবু ছেড়ে যেতে হল, যেতে হবে তাই৷

###

১৫ গুপ্তধনের খোঁজ

নতুন এস্টেটের সামনে দিয়ে একটা চওড়া রাস্তা, লিঙ্ক রোড, কারখানার গেট থেকে বেরিয়ে পূব পশ্চিম নাক বরাবর জি.টি. রোডে পড়েছে৷ পূব দিক বাদ দিলে তিনদিকেই এক ইটের পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল, সাইন কার্ভ়ের মত ঢেউ খেলানো, যাতে হাওয়ায় পড়ে না যায় — আর্কিটেক্ট ইয়ং সাহেবের অনবদ্য সৃষ্টি৷ তাঁর ছেলে জন আমাদের সঙ্গে পড়ত, থাকত সাহেবদের জন্য বরাদ্দ কমপাউন্ডে — বিলাসের অমরাবতী৷…

লিঙ্ক রোডের (রাস্তার নামগুলো ক্যাজুয়ারিনা ওয়াক, ক্যানা অ্যাভ়িনিউ ইত্যাদি — মদীয় পিতৃদত্ত; একটা বিশুদ্ধ দেশি নাম, শিরিষ গাছে সমৃদ্ধ শিরিষ বীথিকা, অবশ্য ধোপে টেঁকেনি) উত্তরে দোতলা বাড়ি সব, নিচে দুটো ওপরে দুটো ফ্ল্যাট৷ ঠিক সার বেঁধে নয়, গায়গায়েও নয়, জায়গাটার  ভূগোল মেনে, যথাসম্ভব গাছ না কেটে, সন্তর্পণে উপস্থাপিত, যাতে খামোখা খটকা না লাগে৷ বাড়িগুলোর সামনে পায়ে চলার জন্য ইটের পথ, লিঙ্ক রোডের সমান্তরাল; তা থেকে সমকোণে গৃহাভিমুখী অনুরূপ পথ প্রত্যেক বাড়ির সামনের লম্বাচওড়া লনগুলোকে দ্বিখন্ডিত করছে৷

মেহেদির বেড়ায় ঘেরা লনে আমরা বড়-হয়ে-যাওয়া খেলা খেলতাম: ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, পিট্টু, আর ট্রাইসাইকেল সজোরে চালিয়ে পেছনের একটা চাকা শূন্যে তুলে দ্বিচক্র ব্যালান্সের খেলা৷ ওই লনে আমি বাইসাইকেলও চালাতে শিখি: ম্যানজ়েল এঞ্জেলো, স্টিভ়েন পেট্রোজ়া আর জ্যাকি স্টিফ়্ল্ (স্ত্রীং!) আমার এক রাশ কমিক ধার নিত — পড়তে যতক্ষণ লাগে তাদের চোদ্দ কিংবা ষোলো ইঞ্চি সাইকেল ততক্ষণ আমার৷ ফ্ল্যাটগুলোর পেছনে, বাগান আর নয়ানজুলি পেরিয়ে স্কাউটস’ ডেনের মাঠ, সেটা পেরিয়ে আরো কিছু নির্মীয়মান কোয়ার্টার আর ৮৪ একর সদ্য কেনা অনাঘ্রাত জঙ্গল৷ কুন্ডুদের জায়গা ছিল আগে, তখনও ছিল তাদের চাকর মহলের ধ্বংসস্তুপ এবং খিড়কির মজে আসা পুকুর — লোকে কুন্ডু পুকুর বলে৷ সেখানে আমরা গুপ্তধনের খোঁজে বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি করতাম৷

আমার ন’বছরের জন্মদিনে মা কিনে দিয়েছিল একটা ডায়ানা এয়ার রাইফ়ল, ভ়েরি এক্সপেন্সিভ়, ২৫ টাকা! তবে লিডারশিপের জন্য দুর্দান্ত৷ আমার ভাই আমার চেয়ে প্রায় দশ বছরের ছোট; তার জন্মের সময়, ১৯৫৬-তে, বাবা দিলেন বয়ঃপ্রাপ্ত চব্বিশ ইঞ্চি এভ়ন সাইকেল (অনেক দিন হাপপ্যাডেলে চালাতাম), আজ মনে হয় হয়ত ঘুষ হিসেবে৷ এ-দুয়ের মণিকাঞ্চন যোগেও আমার ভবিষ্যৎ নায়কত্ব পাকা হল না!

১৯৫৪-র মাঝামাঝি থেকে আমরা নতুন এস্টেটের ১১৬ নম্বরে৷ জনডিসের জন্য প্রায় একবছর গৃহবন্দি থাকার পর ১৯৫৫-র জানুআরিতে কোম্পানির বাংলা স্কুলে ভর্তি হলাম, পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ক্লাস ফ়াইভ়ে৷ মলয় বাদে ক্লাসের সব্বাই পুরনো, কিন্তু আমার কাছে বুলটু, পতাকী, শঙ্কর, জাপান, পাঁচুগোপাল কান্ডি, সুভাষ, বিমান, দুই দীপালী, চম্পা, ছন্দা, আরতি, প্রণতি — আনকোরা নতুন৷ মলয় করও আমার মত সেবারই ভর্তি হল কলকাতা থেকে এসে৷ শুধু টাইফয়েডে বেদম ভুগে নতুন করে ভর্তি হল আলো বলে একটা মেয়ে — আলো মজুমদার; স্বভাবতই তার সঙ্গে আমার ভাব হল বেশি৷ কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে ভাব করে লাভ নেই: তারা ফুটবল ক্রিকেট ডাঙ্গুলি লাট্টু খেলতে চায়না, পারেওনা; অগত্যা…!

বলতে দ্বিধা নেই, আমার প্রাণের বন্ধু ছিল কানাই হালদার — ঈশ্বরবাগে বাড়ি, তার বাবা কোম্পানির শ্রমিক৷ কত কি শিখেছি তার কাছে — অমোঘ চার আর অব্যর্থ টোপের সুলুক সন্ধান: সর্ষের খোল, মেথি, দুধের সর (অভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে বুগনুর কাউ এন্ড গেটের এক খামচা মহার্ঘ্য গুঁড়ো দুধ … মাছ যাবে কোথায়!), আরও কত কি সব ঘিয়ে ভেজে তৈরি সেই গোপন ফর্মুলার চার, ছিপ ফাৎনা বঁড়শি বাঁধা, খ্যাঁচ মারার টাইমিং; নারকেল তেল আর কস্টিক সোডা মিশিয়ে গোলা-সাবান তৈরি; নানান জংলি গাছগাছালির গুণাগুণ… ঋণের শেষ নেই!

প্রথম হেডমাস্টার ছিলেন যিনি, তাঁর নাম মনে নেই তবু তাঁর বিরলকেশ, প্রবীণ চেহারাটা চোখের সামনে ভাসে৷ কমাস বাদেই এলেন জিতেনবাবু, সতীদির বাবা; কয়েক বছর পর কোনও কারণে তাঁকে চাকরি ছাড়তে হয়৷ তদ্দিনে অবশ্য আমি চুঁচড়োর স্কুলে৷ দু-বছর মাত্র ছিলাম, কিন্তু মায়ায় জড়িয়ে ছিলাম তার চেয়ে ঢের বেশি৷

এই পর্বে আমার দিগন্ত অতি দ্রুত পিছু হটছিল৷

সামনের সর্পিল পাচিল আর পেছনে, স্কাউট’স ডেনেরও পেছনে, চুরাশি একর জঙ্গল পেরিয়ে; বাঁশবেড়ের হংসেশ্বরী-বাসুদেবের মন্দির ছাড়িয়ে ত্রিবেণীর গাজির ঢিপির কাছ বরাবর; উল্টোবাগে পুরনো পোস্টাপিস, পেরেক কল, ব্যান্ডেল চার্চ, হুগলি বালির মোড়, চকবাজার ডিঙিয়ে ওলন্দাজদের শহর চুঁচড়োর ঘড়ির মোড় অবধি৷ বন্ধুদের সংখ্যাও জ্যামিতিক হারে বাড়ছিল, ইশকুলের বা পাড়ার বন্ধু ছাড়াও এদিক ওদিক সেদিকের বন্ধু৷ যদিও, কোনো কারণে, অবশ্যই আমার নিজেরই দোষে, আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুর সংখ্যা চিরকালই কম; এখন যত তখনও প্রায় ততজনই৷ সম্পর্কের গন্ডি বাড়তে থাকলে, এবং চোখ কান মনের দরজা হাট করে খুলে রাখলে, মানব বৈচিত্র্যের একটা ঝাপসা মত আন্দাজ পাওয়া যায়, যে আন্দাজ অনেকের পরিণত বয়সেও অকুলান৷ সেটা মানুষের দোষ নয়, ইন্দ্রিয়ের অসুখ; একরকম অন্ধত্ব, বধিরতা; দরজা খোলার মত কাজে আলস্য৷ তা ছাড়া, তখন আমাদের টিউশনের চাপ, গান শেখা, ক্রিকেট শেখার, পেট থেকে পড়েই ডাক্তার এঞ্জিনিয়ার আই.এ.এস. বনবার বাড়তি চাপ ছিল না, তাই হয়ত নিজেরা নিজেদের মত ইচ্ছেশিক্ষা করতে পারতাম।

একদিকে, সেই ব্যাঙের কুয়োর মত বদ্ধ দুনিয়ার নিম্নতম থেকে সর্বোচ্চ স্তরের স্ব-স্ব চেহারা আর তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, অথবা সম্পর্কের অভাব — কয়েকটি ধানের শিসের উপর কয়েকটি শিশির বিন্দু — নিজের চোখে দেখতে আর চিনতে শিখলাম, একটু একটু করে — শিশু যেমন আস্তে আস্তে অ-আ-ক-খ শিখে তারপর যুক্তবর্ণে উন্নীত হয়, চেলাগিরির সময় পোটো যেমন আগে আধমাটির কাজ শিখে বয়সকালে দুগ্গা গড়তে শেখে৷ চরিত্র পাঠে অবশ্য কাজের কাজ কিছু হয়না, বরং ক্ষতি অনেক, সাত পাঁচ দেখে তখন মনে দশ রকম অকারণ ভয় জন্মায় — সম্পর্ক গড়ার ভয়, সম্পর্ক ভাঙার ভয়, মানুষকে অজান্তে আঘাত করে ফেলার ভয়, অন্যের ক্ষতি করে নিজের আখের গোছানোর অব্যক্ত আশংকা! অন্যদিকে বই পড়া জ্ঞানের সঙ্গে বাস্তবকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ পেয়েছিলাম ওই অল্প কয়েকটা বছর৷ লাভের মধ্যে কেবল জটিল বীজগনিতের মত অনেকগুলো সমাধান সুত্র আমার মনের মধ্যেই জড়ো হয়ে গেছে, চাই বা না চাই; তাতে আখেরে লাভ হয়না, তবে লোকসানও নেই কিছু। এখন, বয়সকালে, হাতে যখন অঢেল সময়, সেই সব গাণিতিক সমাধান অনেকখানি একলা সময়ের মধ্যে মনের মধ্যে যৌবনের ভোমরার মত গুনগুনিয়ে ওঠে থেকে থেকে; ভাগ্গিস কেউ মন পড়তে পারে না!

সেই যে অসিত হালদারের ছড়া আছে না —

আহ্লাদি পুতুলের তিনটি ছেলে

খিদে পেলে খায় না কো মাকে ফেলে

কাঠখোদা কুকুরের বড় করে ভয়

তাই তারা সর্বদা মা’কাছে রয়

 তাদের মত ঘরকুনো, মা ঘেঁষা হলে আজীবন কাঠখোদা কুকুরদের ভয় করে চলতে হত। (প্রসঙ্গত, আরেকটা মা ছেলের ছড়া হঠাৎ মনে পড়ল —

পাঁচির মায়ের পাঁচটি ছা

পাঁচটি ছায়ের পাঁচটি পা

পাঁচটি পায়েই পাঁচড়া ঘা!

—  কার লেখা মনে নেই তবে বেশি মা ঘেঁষা হলে দেখছি চর্ম রোগও হতে পারে!)

কুন্ডু পুকুরের অনতিদূরে একটা ইটের ইমারতের ধ্বংসাবশেষ থেকে পাঁচটা রং জ্বলা কড়ি আর গোটা দুই প্রাচীন, কলঙ্ক ধরা তামার পয়সা পেয়েছিলাম একবার, পিটর আর আমি; সে কোন কালের কে জানে! বিস্তর খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়েছিল ওইটুকু প্রত্ন লাভের জন্য। পিটরের ইচ্ছে ছিল কোদাল গাঁইতি নিয়ে আরো গভীর করে খুঁড়ে দেখে; বর্ষা নেমে যাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি৷ তার পর পিটর অনিচ্ছায় যেখানে পৌঁছে গেল, সেখানে গুপ্তধনের কোনও দরকার হয়না। তবু যেন মুঠো মুঠো গুপ্তধন না চাইতেই পেয়েছিলাম নিজের অজান্তে; শুধু ধ্বংসস্তুপের আনাচে কানাচে নয়, পারিপার্শ্বিকের থেকে, অনেক মানুষের গায়ে গা ঘষার ফলে, তাদের ভাষা ব্যবহারের, সংস্কারের, বিশ্বাস অবিশ্বাসের অবচেতন বিশ্লেষণে৷ তাতে অভিজ্ঞতার ঝুলি আপনিই ভরে গিয়েছিল সারা জীবনের মত।

###

Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>





সেই জোনাকিরা (১০–১২) ৷৷ অনিরুদ্ধ সেন

3 05 2013

There are 19 sections of these memoirs, divided into 6 posts, this being the fourth.

১০ হাট বসেছে শুক্রবারে

বারো কোয়ার্টার এবং তার বাইরে, শা’গঞ্জ বাজার, কারখানা, স্পোর্টস গ্রাউন্ড পেরিয়ে স্টাফ কোয়ার্টারে, সেই যেখানে আন্টি ডি’ক্রুজের স্কুল, কোনওখানেই বন্ধুবান্ধবের অভাব ছিলনা আমার৷ গুচ্ছের তুতো ভাইবোন ছিল দুনিয়া জুড়ে, মায় খামারপাড়াতেও দেবুদা আর শঙ্কু — তাদের ঠাকুমাকে আমরা ছোটোমা বলতাম, বাবার খুড়িমা৷ দেবুদাদের বাবাকে আমি দেখেছি বলে মনে পড়ে না৷ ছোটোমার অন্য দুই ছেলে নিলুজ্যেঠা (সত্যেন সেন, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য) আর লুকুকাকা (লোকেন সেন, শা’গঞ্জেই কর্মরত)৷ লুকুকাকার সঙ্গে খামারপাড়াতেই থাকতেন ছোটমা৷ রত্নগর্ভা তো বটেই, অসাধারণ রান্নার হাত ছিল, চৌষট্টি ব্যঞ্জন নিরামিষে নানার চেয়েও ভালো; আর আমসত্ত আচার মোয়া নাড়ুতে সিদ্ধহস্ত; ঘরেই তৈরি করতেন যাবতীয় পাঁপড়৷ বিজয়ার পর পদ্মচিনির চাক দিতেন অন্যান্য স্বহস্ত রচিত লোভন খাবারের সঙ্গে: পদ্মের চাকাপানা ভেতরটা, পাপড়ির আড়ালে যেটা থাকে, সেটা সন্তর্পনে বের করে হালকা চিনির রসে আসাতে হয়, তারপর শুকিয়ে নিলে পদ্মচিনির চাক — মুখে মিলিয়ে যায় আপন সুবাস সমেত, মিষ্টত্বের রেশও থাকেনা, শুধু স্মৃতিটুকু থেকে যায়৷

আর কলকাতায় তো তখন আত্মীয়স্বজনের ছড়াছড়ি! ঘড়ির কলকবজার মত ফি শনিবার আমরা কলকাতা যেতাম, ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে দুপুর একটা কুড়ির ধূলায় ধূসর ইন্টার ক্লাসে৷

আমার বড়মাসি আর মেসো, সসন্তান ঢাকা উর্দু রোডের শঙ্কর ভবনে থাকতেন৷ দেশ ভাগের পর চন্দননগরে ছিলেন কিছুদিন, সেখানে তাঁদের ভাঙা হাটের পুনর্নির্মিত ঢাকা আয়ুর্বেদিক ফার্মেসির কারখানা৷ দিপুদা আর অপু দুজনে আমার ভাইক্কে ভাই, বন্ধুক্কে বন্ধু; বোনেরা ভবিষ্যতের গর্ভে৷ ওরা ছাই রঙা দশনসংস্কার চূর্ণ দিয়ে দাঁত মাজত, দেখে দেখে আমিও কিছুদিন তাই; আমি অবশ্য বলতাম, দশম সংস্করণ , হয়ত নিবিড় পুস্তকপ্রেমের মোহে! ওরা ডিম ভাজা, মানে ফ়্রায়েড এগকে বলত পোচ (বেশিরভাগ বাঙালি অবশ্য এখনও তাই বলে), খেত নুন-মরিচের বদলে হজম-সহায়ক ভাস্কর লবণ ছিটিয়ে, অতএব আমিও৷ ওদের চন্দননগরের বাড়িটা আবছা মনে আছে, তবে কলকাতায় পাকা আস্তানা ছিল শঙ্কর ভবনের বদলে পাওয়া, লেক মার্কেটের উল্টো দিকে ঠাকুরবাড়ি রোডের একটা বাড়ি, টিপু সুলতানের অনেক কলকাতাস্থ বংশধরদের কারু আবাস ছিল আগের জন্মে, দিপুদা অন্তত তাই দাবি করত, দৃশ্যমান কোনও সুলতানি আভাস ছাড়াই৷ সেখানে ফাউ হিসেবে পেয়েছিলাম অপুদের জ্যেঠতুতো ভাই, আশিসকে৷ কেউ যদি জিজ্ঞেস করত আমরা ক ভাইবোন, দুহাত দুপা মিলিয়ে কুড়িটা আঙ্গুলেও কুলোত না; জ্যেঠতুতো খুড়ততো মাসতুতো পিসতুতো মামাতো আর পরস্মৈপদী সবাইকে জুড়তে হবে তো!

শা’গঞ্জে বসেই বেশ কিছু নাগরিক আকর্ষণ উপভোগ করতাম আমরা৷

বুধবার বুধবার ব্ল্যাক জাপান করা তোরঙ্গ মাথায় কেকম্যান আসতো বিকেল চারটে নাগাদ৷ যখনই আসুক, তারহীন টরেটক্কায় পাড়ার শিশু মহলে খবর পৌঁছে যেত লহমায়; তাদের আরক্তমুখ মাতৃকুল লজ্জা রাখার জায়গা পেতেন না৷ সরভাজা সরপুরিয়াওয়ালা, নিয়ম করে নয়, যখন ইচ্ছে তখনই আসতো৷ শীতের পরিযায়ী পাখিদের সঙ্গে আসতো খেজুর গুড়ের নাগরি পাটালি আর মোয়া নিয়ে জয়নগরওয়ালা৷

ওই শীতেই ব্যাঞ্জো আর একর্ডিয়ন নিয়ে কলকাতার বো ব্যারাক থেকে আসতো ফিরঙ্গ গায়ক, সচরাচর দুজন, শুক্র শনি রবি বাদ দিয়ে হপ্তায় যে কোনও এক দিন সন্ধ্যায়, ফ্র্যাংক সিনাট্রা আর আর্থা কিটের গুড় মাখানো গান গুলো গাইতে৷ ক্যারল গান আমি তাদের মুখেই প্রথম শুনি … “টিল রিঙিং সিঙিং অন ইটস ওয়ে,/  দ্য ওয়র্ল্ড রিভ়লভ়ড ফ়্রম নাইট টু ডে,/ আ ভ়য়স, আ চাইম, আ চান্ট সাবলাইম/ অভ় পীস অন আর্থ়, গুড উইল টু মেন …৷” ছোটদের জন্যেও গাইত তারা দুএকটা গান৷ একটা গানের কথা আমার স্মৃতিতে গেঁথে গেছে: “শি’ল বি কামিং রাউন্ড দ্য মাউন্টেনস, হোয়েন শি কামস, সিঙিং আই আই য়িপ্পি য়িপ্পি আই৷” এখানে বলে রাখা ভালো, গানটার লিরিক নিয়ে আমার একটা ধন্দ আছে; আমার স্মৃতিতে “শি’ল বি ওয়্যারিং সিল্ক পাজামাস, হোয়েন শি কামস” একই গানের অঙ্গ, কিন্তু রসিক জন বলছেন সেটা বিশ্ব যুদ্ধের সময়কার অন্য একটা বড়দের  অর্থবহ গানের কলি, হয়ত বাবা তাঁর মার্কিন সহবৈমানিকদের কাছ থেকে শিখে নিজের মনেই গাইতেন — আমার স্মৃতিতে তার অনধিকার প্রবেশ হয়ত সেই সূত্রে৷

বাংলা গান — দাশু রায়ের পাঁচালি কিংবা রামপ্রসাদী — গাইতে আসতো হুগলি ঘাটের অশীতিপর নন্দ ধীবর৷ জাত গাইয়ে, দানাদার বলিষ্ঠ গলা, যদিও গায়কিটা গ্রাম্য ধাঁচের৷ তার একটা গানের এক কলি আজও মনে আছে: “শুনেছি লোকে শেখে, লোককে দেখে,/হাবা লোকে ঠেকে শেখে” — কার বাঁধা গান কে জানে! মাকে বলেছিল, “আমরা জেলেকৈবত্ত বটি কিন্তু ভালো ঘর, আমার বাপ ছেল ম্যাকলয়ড ঠিকেদারের ফদ্দোনবিশ৷” ফার্সি নবিশ  ডেজ়িগনেশনটার মানে বুঝেছি পরে৷ অনেক বছর পর একটা সিনেমায় মরিস শেভ়ালিয়রের গান শুনে নন্দ জেলের কথা মনে পড়েছিল — নিশ্চয়ই মিল পেয়েছিলাম কোথাও!

শুক্কুরবার বুকম্যান আসতো, তার ঝোলায় কাগজ মলাটের রগরগে হত্যা রহস্য, আন্টিদের জন্য মিলস অ্যান্ড বুন জাতীয় দ্বিপ্রাহরিক রোম্যান্স, কাকিমা মাসিমাদের জন্য বাংলা উপন্যাস, গুচ্ছের ম্যাগাজিন আর প্যাটার্ন বই, দিস্তা দিস্তা কমিক: যথা ডেল, লুনি টিউনস, সুপারম্যান আর ক্লাসিকস আখ্যার ডক্টর জেকিল এন্ড মিস্টার হাইড, টেল অভ় টু সিটিজ় জাতীয় গল্প৷ মিকি মাউজ় বা ডনাল্ড ডাকের ডিজ়নি কমিক তার কাছে দেখিনি (সে সব পাওয়া যেত হাওড়ার হুইলারে কিংবা নিউ এম্পায়ারের উল্টোদিকের দোকানে) তবে সুপার ডাক বলে একটা অ-ডিজ়নীয় সিরিজ ভালোই লাগত পড়তে৷

কোম্পানির অডিটোরিয়ামটা, নির্ভেজাল সিনেমা হলের রূপ ধারণ করার আগে, যথার্থই বহুমুখী ছিল৷ সকালে বাংলা স্কুল চতুর্থ শ্রেণী অবধি, যদ্দিন না আলাদা স্কুল বাড়ি তৈরি হয়৷ হপ্তায় পাঁচ দিন, বিকেল চারটে থেকে রাত নটা পর্যন্ত সেটা অনেকগুলো তাসের, কয়েকটা ক্যারমের আর গুলতানির টেবিল এবং একটা টেবল টেনিস বোর্ড সম্বলিত ক্লাব ঘর, চা চানাচুর সিগারেট আসতো মুনসির দোকান থেকে; তত্ত্বাবধানে ক্লাব চাটুজ্জে, তাঁর পিতৃদত্ত নামটা তখনই অনুদ্ধারণীয়৷ একটু দুরে কংক্রিটের টেনিস কোর্ট, বল সংরক্ষণের জন্য খেলার সময়টুকু লাইনিঙের পর্দা দিয়ে ঢাকা৷ কারখানায় ব্যবহৃত মোটা সুতির তাগড়া লাইনিং অল্প ছিঁড়ে গেলে বাতিল করা হত; তাপ্পি মেরে নিলেই খাসা বল আটকানোর পর্দা৷ শীতকালে ক্লাবের পেছনে  ব্যাডমিন্টন কোর্ট কাটা হত৷ ক্লাবের একপাশে একটা রেস্টলিং পিট —  আসলে  ধুলো করা গঙ্গা মাটি দিয়ে বোঝাই একটা আয়তাকার গর্ত, সিজ়ন টাইমে ঈষৎ তৈলাক্ত, তার চেয়েও বেশি ঘর্মাক্ত, ভর বর্ষায় সকর্দম৷ যাদের আমরা হিন্দুস্থানী বলতাম, সেই হিন্দিভাষীরা রোজ ভোরে সেখানে ধুপ ধাপ করে পরস্পরকে আসমান দেখাত৷ শুক্কুর শনি দুই এবং তিন শোয়ের সিনেমা; শুক্কুরের রাত আটটার শোতে বাছাই করা ইংরেজি ছবি, বাছাই করতেন স্বয়ং পিতৃদেব৷ আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রগুলো — বাইসিক্ল থীভ়স, সিটি লাইটস, হাউ গ্রীন ওয়জ় মাই ভ়়্যালি — সেই হলে দেখা৷ ওয়েস্টার্ন বলে পরিচিত ব্যাং ব্যাং (মার্কিন ভাষায়, অবশ্যই সংস্কৃতে ভেক ভেক নয়) ছবি, যা দেখেছি, সব সেখানেই৷ সিনেমার দিন অবস্থা বুঝে ছোলা বাদাম ওয়ালারা জমায়েত হত, বাদাম ভাঙার মড়মড় (বানান অভ্রান্ত!) ধ্বনিতে গোটা হল শব্দায়মান, পায়ের তলায় — শুকনো পাতা নয় — খোলা ও ঠোঙা মথনের মর্মর ধ্বনি (এটাও নির্ভুল!)৷ মশলামুড়ি-ওয়ালাও আসতো; তবে, দক্ষিণের ভারত মহাসাগরটুকু বাদ দিয়ে আসমুদ্রহিমাচল যারা ভিন্ন ভিন্ন নামে দাপটে রাজত্ব করে, সেই ফুচকা পানিপুরি গোলগাপ্পা ঘুপচুপওয়ালাদের সেখানে দেখেছি বলে মনে পড়ে না৷ তারা বসত শহরের স্কুলগুলোর কাছে, হুগলি কিংবা চুঁচড়োয়, বড় সিনেমা হল রূপালি আর কৈরির পাশের গলিতে — কলকাতার পেশাদারি ফুচকার কাছে স্বাদে বা পরিবেশনে নগন্য!

ওই অডিটোরিয়ামেই ডিসেম্বরের একটা দিন বসতো মহিলা সমিতির বিকিকিনি মেলা; সেখানে আমরা মহানন্দে লাকি ডিপ (এলেবেলেদের জন্য), হুপলা (বেতের রিং ছুঁড়ে সাজানো প্রাইজ়ে গলানো), কোকোনাট শাই (কেঠো বল ছুঁড়ে বাঁশের মাথায় স্থাপিত নারকেল ফেলা), লাকি স্কোয়ারের জুয়ার খেলা খেলতাম, মা মাসিদের হাতে তৈরি খাবার এবং নিষিদ্ধ বাজারি খাদ্যাখাদ্য সকল কিনে খেতাম৷

হাসি আর প্রতিমার বাবা মারা যান ক্ষয়রোগে; হাসির মা — তাঁকে আমার বেশ মনে আছে — সেলাই ফোঁড়াই করে দিন গুজরান করতেন৷ তাঁর সাহায্যের জন্য বিকিকিনি মেলা শুরু হয়, আসলে ছিল বিলিতি ভ়িকারেজ ফ়েয়ারের নকলে সেল অভ় ওয়ার্কস, সঙ্গে যার যা কিছু বাতিল বা বাড়তি সামগ্রী (হোয়াইট এলিফ়্যান্ট) বাড়িতে জঞ্জাল হয়ে আছে — যথা পেপারব্যাক নভেল, উপহারে পাওয়া ফুলদানি, অসহ্য চড়া রঙের শাড়ি, মলিন হয়ে যাওয়া ফ্রেম সুদ্ধ ছবি — তাদের বিদায়্করণ৷ জুয়ার রোজগারটা উপরি৷ মা ছিলেন একজন পালের গোদা; উমাদি, শান্তিনিকেতনের উমা দত্ত (২০১৩-র ৪ঠা নভেম্বর নিরুনব্বুই পার করেও তাঁর মাথাটা এখনও তারিফ করার মত পরিস্কার, ক্বচিৎ কদাচিৎ ফ়োন করলেই চিনতে পারেন, আলাপচারী চালান যেন কালকেই আমাদের বাক্যালাপ শেষ হয়েছিল), বিকিকিনি নামটা বেছেছিলেন; আর সে যজ্ঞের প্রথম অগ্নিহোত্রী ছিলেন মিসেস জ্যাকসন৷ ক্রমে সেই বিকিকিনি বৃহত্তর স্বার্থে বাৎসরিক মেলায় উন্নীত হয় এবং ক্রমে ক্রমে চরিত্র হারায়৷

স্কুল বলুন, ক্লাব হাউস বলুন, সিনেমা বলুন, গুদাম ঘরের মত ওই ইমারৎটিতে অনেক ইতিহাস তৈরি হয়েছে একদা৷

সামনেই ছিল প্রায় আড়াইটে প্রমাণ সাইজ ফুটবল মাঠের মত সাবেক স্পোর্টস এবং প্যারেড গ্রাউন্ড৷ সেখানে সারা বছর দেদার ফুটবল, হকি আর ক্রিকেট খেলা হত৷ মাঝে মাঝে ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগানের মত বড় দল প্রদর্শনী খেলা খেলে যেত; শৈলেন মান্না বদরু ব্যানার্জি থঙ্গরাজ সালে কিট্টু ইত্যাদি নাম একেকটা সেরকম খেলার পরে বহু দিন ধরে লোকের মুখে ফিরত অঙ্গভঙ্গি সহকারে৷ বছরে একদিন কোম্পানির বাৎসরিক স্পোর্টস উৎসব হত ঘটা করে — তার নেপথ্য খাটনির সিংহভাগ বাবার ঘাড়ে৷ ক্লাব-ইভ়েন্ট ওপেন-ইভ়েন্ট মিলিয়ে সারা দিনমানের স্পোর্টস;  পুরস্কার  বিতরণের আগে শেষ  দুটো ইভ়েন্ট ছিল গো-অ্যাজ়-ইউ-লাইক এবং কোম্পানির দমকল ও রক্ষী বাহিনীর দড়ি-টানাটানির লড়াই৷ দমকলের লোকেরা নাকি বসে থেকে থেকে খুঁটি হওয়ার যুগ্যি মোটা হত আর খাস সৈন্যবাহিনী থেকে আসা দরোয়ানরা আদতে পালোয়ান৷ বিতরণের নিয়মটা কি ছিল সঠিক জানিনা, তবে যাদের কাছেই স্পোর্টসের প্রোগ্র্যাম বই থাকত, তার পেছনে ছাপা একটা নম্বরি কুপনের বদলে সমবেত দর্শকবৃন্দকে একটা করে এলাহি খাবারের বাক্স দেয়া হত, আর তা ছাড়াও একটা করে বাছাই কমলালেবু; খোসা ছাড়ানো যায়না এমন পঞ্জাবি কিনু নয়, পাতিলেবুর মত দার্জিলিংও নয়, বোধহয় বিশুদ্ধ কর্নাটদেশীয় নাগরঙ্গ!

বাবার আমলেই বেঙ্গল অলিম্পিক এসোসিয়েশন তাকে প্রথম শ্রেণীর স্পোর্টসের মর্যাদা দেয়৷ তারপর কারখানার বাড়তি কাজের দরকারে কারাপ্রাচীরের করাল গর্ভে ঢুকে যায় সেই মাঠ, সেই প্রথম শ্রেণীর বনেদিয়ানা৷ ঠিক যেমন করে বন কেটে মানুষের বসত দরকার মত বাড়ে, যেমন করে খান্ডব বন জ্বালিয়ে অযুত মৃগপক্ষিকুলের বসত, অরণ্যচারী শবরদের জীবনযাপন নষ্ট করে সভ্যতার বিকাশ হয়৷

###

১১ অনুসন্ধান

এক অনুপম সুন্দরীকে তিনি দূর থেকে কালবৈশাখীর বিদ্যুল্লতার মত এক ঝলক দেখেছিলেন; তাকে আরেকটিবার দেখার জন্য সব কিছু — এমনকি সমরকন্দ বুখারার তামাম ঐশ্বর্যও — বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত ছিলেন সেই রহস্যের কবি হাফ়েজ়়৷ অত অনুভব, অত রহস্য, অত ঐশ্বর্য, কাঙ্গাল আমি পাব কোথায়! তবু সেই শ্রাবণের অনন্যসাধারণ জোনাকিদের আরেকটিবার দেখার জন্য আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারতাম, নিশ্চিত৷ আমার বুকের ভেতর ধিকিধিকি করে তুষের মালসার মত যে আগুন জ্বলছিল তাদের দেখার পর, তাতে কালেকালে অনেক ইন্ধন যুগিয়েছে আমার পারিপার্শ্বিক৷ সেই দেওঘরে একদিন হাড় কাঁপা শীতে হিরালাল তুষের মালসা দিয়ে গিয়েছিল ঘরে৷ যতক্ষণ জেগেছিলাম, দেখেছি, হয় মা, নয়তো বাবা, তাতে আরো তুষ, আরো তুষ, শেষকালে কয়েকদিনের জমানো খবরের কাগজ গুঁজে দিয়ে জিইয়ে রাখতে চাইছিলেন তার ওম, কিন্তু কটু ধোঁয়ায় ঘর ভরে গেল বলে সে চেষ্টা ছেড়ে দিলেন অবশেষে৷

অনেক দিন সেই মৃগতৃষ্ণা আমার পিছু ছাড়েনি, বহু বছর … কাঁচা সুপুরি যেমন চর্বণে চর্বণে নির্মূল হয়ে যাওয়ার পরও তার কষা স্বাদ আর হালকা মাথা ঝিমঝিম বহুক্ষণ থেকে যায়, শেষের দিকে ভালো লাগে না আর, মনে হয়, আপদ! কোথাও হয়ত তার একটুখানি রেশ থেকে গেছে দীর্ঘ কাল৷ তার পর অনেক জোনাকি দেখেছি সারা জীবন, তবু তেমনটি দেখলাম না আর!

বাবার মৃত্যুর তিন বছর পর কেওটা-লাটবাগানে বাবারই কেনা জমিতে একটা বাড়ি তুলেছিলেন মা৷ সেখান থেকে কোম্পানির কারখানা সিধে পথে পৌনে মাইল, গাড়ি নিলে ঘুরপথে যেতে হয় বলে মাইল আড়াই৷ কি সাইকেলে, কি গাড়িতে, সন্ধেবেলা কোম্পানির ক্লাবে যাওয়ার সময় সর্পিল শরৎ সরণি দিয়ে ওই ঘুরপথটাই বেছে নিতাম অজান্তে৷ শরৎ সরণিই একদা ছিল শাহি সড়ক — দ্বিতীয় যুদ্ধের সময় মার্কিন সেনা সরলতর, প্রশস্ততর গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড নির্মাণ করা অবধি৷ পরে সেটা স্থানীয় রাস্তা হয়ে গেল, অপ্রশস্ত, কোথাও দুপাশে সরু ইটের সাবেক হর্ম্যশ্রেনীর মধ্যে শুঁড়ি পথ৷

আমার  পছন্দ  ছিল  কেওটা  থেকে  জি.টি. রোড পর্যন্ত বৃক্ষগুল্মময় আঁকাবাঁকা একটা ক্ষুদ্র অংশ৷ অর্ধশিক্ষিত নেতারা মিলে (যেমন তাঁদের দস্তুর) সেই সর্পিল রাস্তার নব নামায়ন করেন যে ঔপন্যাসিকের নামে, তাঁর সাতগাঁয়ের ভিটে, বা হুগলি শহরের ব্র্যাঞ্চ স্কুল যেখানে দত্তা-র তিন বন্ধু লেখাপড়া করতেন, কস্মিনকালেও সে পথের আওতায় ছিল না৷ বরং, দেবযানের বিভূতিভূষণ সে পথের বালির মোড়ে বিলীন একাংশে ছিলেন কিছুকাল, এবং প্রসন্ন গুরুমশাইয়ের পাঠশালা ছিল অনতিদূরে কোথাও, ছোট্ট অপু পড়তে যেত সেখানে৷

শরৎ সরণির যে ছিন্ন অংশটা আমার পছন্দের, তার অরুন্তুদ নিস্তব্ধতা ভেদ করত ঝিঁঝির আর মত্ত দাদুরির ডাক — উভয়েই আষাঢ় শ্রাবণে সূর্যাস্তের পর মিলনপিয়াসী৷ পির বাবার উপেক্ষিত ইটের মাজারটা পেরিয়ে চুলের কাঁটার মত যে বাঁক, সেখানে ছিল অনেকগুলো ঝাঁকড়ামাথা আশশ্যাওড়া, দেখেই বোঝা যেত অনেকদিনের, হয়ত পাবড়া ছোঁড়া ঠ্যাঙ্গাড়েদের বলি অনেক নিরীহ পথিকের শব সার সঞ্চার করেছে তাদের ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠায়৷ আধা জ্যোৎস্নার সিলুয়েটে দেখলে একটা গাছের মাথা সগ্রীব উটের মত লাগত; আমার প্রিয় গাছ ছিল সেটা, আকাশমুখী হয়ে নিশ্চিন্তে জাবর কাটা উট৷ অবশ্যই উটের গ্রীবার মত  উদ্ভট সেই জনহীন শ্যাওড়াতলার নিস্তব্ধতা৷ জায়গাটা সাদামাটা, গেরস্ত জোনাকিদের খুব পছন্দের, তারা সেখানে মহানন্দে নাচ দেখাত৷ কিন্তু তাদের সে জলুস কই? উজ্জ্বলতা বুদ্ধি গ্ল্যামার ও যৌন আবেদন? তবু একেকদিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুঁজতাম তাদের, যদি ভুল করে দেখা দেয়!

আমার বিয়ের ক’মাস পরে বর্ষায় সেখানে একবার গাড়ি থামিয়ে উট গাছটা চেনাচ্ছিলাম আমার স্ত্রীকে৷ ভালো করে দেখানোর জন্য গাড়ি থেকে নেমে একটা ভ়্যান্টাজ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছিলাম দুজনে৷ যে আটপৌরে জোনাকির দল সেখানে ঘোঁট পাকিয়ে বেহায়াপনা করছিল, তাদের দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেল রিনি: “দেখো কত জোনাকি ওখানে!” কি করে তাকে বোঝাই যে তারা আমার ছেলেবেলার সেই জোনাকিদের বাঁ পায়ের কড়ে আঙ্গুলের নখের যুগ্যি নয়!

…একটা মিশ্র আবহাওয়ায় বড় হয়েছিলাম আমি: মিশ্র ভাষা ও সংস্কৃতি; মিশ্র কাল: যুদ্ধোত্তর শান্তিকামী দুনিয়া, মন্বন্তরের পর আপাত স্থিতাবস্থা, স্বাধীনতার ইউফ়়োরিয়া, দেশভাগের হাহারব; মিশ্র স্থানভেদ: শা’গঞ্জ, শান্তিনিকেতন, কলকাতা৷ কখনও ধানখেতের আলিপথ ধরে হেঁটেছি, কখনও নাগরিক ফুটপাথ়ে৷

একদিকে আমরা শনিবার শনিবার ট্রিংকাতে চা পেস্ট্রি খেতাম, সুযোগ পেলেই ম্যাগনোলিয়া বা হ্যাপি ভ্যালি আইসক্রীম, বিদেশি হ্যাম আর চীজ়, অন্যদিকে রেশনের চিনি ফুরিয়ে গেলে বাবা-মা এখো গুড়ের চা খেতেন, কালোবাজারের চিনি কিনতেন না, দৌরলার চৌখুপি চিনিও নয়৷ একদা শা’গঞ্জ দর্শনে আসা তদানীন্তন খাদ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকেও গুড়ের চা খাইয়েছিলেন মা৷ কি করবেন, মন্ত্রী মশাইয়ের সঙ্গে অত লোকজন, তাদেরও তো দিতে হবে, নাকি! রেশনের ক্বচিৎ কখনও পাওয়া অপেক্ষাকৃত ভালো চালটা আমার জন্য যথেষ্ট জমিয়ে রেখে বাবা মা খেতেন অখাদ্য চাল, শ্যামদেশ বা বর্মা থেকে পি.ডি.এস.-এর জন্য আমদানি করা গোল দানা, ভাত রাঁধার সময় বদ গন্ধ বেরুত৷

সেভাবে  বাড়তে বাড়তে  এক  দিকে  যেমন  একটা  মূল্য  ধরে  দিতে  হয়েছিল,  অন্যদিকে  দুনিয়াদারির রাস্তাগুলো সাফ হয়ে গিয়েছিল — মানুষের সঙ্গে নিষ্কারণ সংঘাত এড়াতে শিখেছি অল্প চেষ্টায়, মানিয়ে নিতে পেরেছি যে কোনো জায়গায়, রকমারি পরিস্থিতির সঙ্গে৷

বয়ঃসন্ধির অমোঘ চিহ্নগুলোও কষ্ট করে কেউ চেনায়নি  আমায়, এদেশে সে রেওয়াজই নেই, পশ্চিমে যা মধুমক্ষিকা ও বিহঙ্গের প্রিয়মিলনের নমুনা দিয়ে বোঝানো বাপ মায়ের দায়িত্ব। চোখের সামনে এত বেড়াল কুকুর, গোয়ালে গোরু, খেতিকাজের বলদ! একবার সেই ১১৬ নম্বরের লনে সাপের শঙ্খ লাগা দেখেছিলাম আমি আর টুকু৷

কেষ্ট মালির হাতে বারো নম্বরের ছোট বাগানও মরশুমে ঝলমল করত, ১১৬ নম্বরের বড় বাগান তো বটেই; বাকি সময় বেল-রজনীগন্ধা, বছরভর গোলাপ — সানন্দে শেখাত আমাকে কলমের কারসাজি৷ শান্তিনিকেতনে একবার পেছনের ধানক্ষেতে পায়েস রাঁধার মাতাল গন্ধ পেয়েছিলাম, হরিপদদা বুঝিয়েছিল, “ধানের বুকে দুধ এয়েচে যে!” স্তোকভারনম্রা যে শ্যামস্বর্ণাভ ঝিউড়িরা জীবনানন্দকে মুগ্ধ করেছিল, আমিও তাদের কাছ থেকে দেখেছি, ঈশ্বরবাগ চন্দনপুর হরিহরগঞ্জে, হাওয়ার দোলায় আপন খুশিতে লুটোপুটি খেতে৷ কোথাও একদিন দেখেছিলাম, বরিশাল না গিয়েও, শ্বেতাঙ্গ লক্ষ্মীপেঁচা মিলনরত যুগল ব্যাং ছোঁ মেরে তুলে নিল বর্ষাস্নাত সন্ধ্যায়, শ্বেতাঙ্গদের যেমন দস্তুর ছিল এদেশে একদা৷  গলিত স্থবির  ছিল না সেই দাদুরী মিথুন, দু –একটি মূহুর্তের ভিক্ষা  মেগেছিল কিনা প্যাঁচাই জানে!

গন্ধেশ্বরী ঘাটে যারা দাহ করতে আসতো তাদের শোকদুঃখধর্মগন্ধহীন বীভৎস হরিবোল আর মাতাল হুল্লোড় বারো নম্বর থেকে স্পষ্ট শোনা যেত নিশুত রাতে৷ সব মিলিয়ে ব্লেকের বা জীবনানন্দের জন্য তৈরি হয়ে গিয়েছিল মন, আমার নিজের মনেও সেই গহন ছায়া — শরতের রোদ্দুরে ঝলমল ভাগীরথীর পাশাপাশি! সেই ভাগীরথীরই মুক্তবেণী ত্রিবেণীর মেলায় বিক্রি হত কাঠখোদা বেনেবউ, মৃন্ময় পেঁচা — সেই সাদা রঙের লক্ষ্মী পেঁচা, মাটির কোলা ব্যাং, খাদ্য ও খাদক, ডোরাকাটা উজ্জ্বল বাঘ, চিরন্তনতার প্রতীকের মত৷

তবু তারা কেউ — কেষ্টমালি, হরিপদদা, ব্লেক আর জীবনানন্দ — আমার সে মোহময় জোনাকিদের ঝোপজঙ্গল গাছগাছড়া পেরিয়ে, কালোকোলো লোহার সেপাইদের এড়িয়ে, গজগামিনীর মত মিলিয়ে যেতে দেখেনি৷

###

 ১২ দক্ষিণে চাই, উত্তরে চাই

বিচারবুদ্ধি শানিয়ে ওঠার আগে মানুষছানাদের মন খুব স্পর্শকাতর থাকে; দুর্বল নয়, শুধু ছাপ তোলার গালার মত নরম৷ কোনও একটা খেলনা হারিয়ে গেলে, কাছের বন্ধু দুরে চলে গেলে, চেনা মানুষের মৃত্যুতে কিংবা চেনা পারিপার্শ্বিক থেকে সরিয়ে নিলে একটা বঞ্চনার বোধ তাদের ভর করে৷ হয়ত সে বোধ কারু সঙ্গে ভাগ করে নেয়ার মত প্রকাশ ক্ষমতাও থাকে না তাদের৷ সে সব সংকটের সময় বড়দের ভাবভঙ্গি গোলমেলে খুব৷ কখনও তারা নিজের কথারই বিরোধিতা করে, কখনও একে অন্যের সঙ্গে ঝগড়া করে; মোট কথা তারা পাকা মাথায়,  ঠান্ডা  মাথায়  ভাবতে পারে  না তখন৷ ছোটরা তখন মনের দুঃখ মনে চেপে বড়দের ছেলেমানষি দেখে আর তাদের অন্তর্নিহিত পরস্পর বিরোধিতার শিকার হয় নীরবে৷ সে অবস্থাটা সুখের নয় খুব৷ দাদু তখন তিলতিল করে মৃত্যুর দিকে কিন্তু তখনও তাঁর বোধশক্তি টনটনে; আমাকে বলেছিলেন ছোটখাটো খুঁটিনাটি সব দেখে রাখতে, সব আপাতবিরোধিতা, সবার অবুঝপনা, রোজ কত কি ঘটে যাহা তাহা  যত তুচ্ছই হোক; “মনে রাখবা, নিজির চোখে দেখা আর নিজির কানে শুনার উপর কুনও সইত্য নাই!”

ফার্স্ট আর্টস পাশ করে, অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদ চর্চা না করে বেঙ্গল মেডিকাল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন দাদু (শচীন্দ্রনাথ), তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে ছিলেন দাদা (ক্ষিতিমোহন) — তিনি সে পাঠ শেষ না করেই অন্য পথে হাঁটেন, সেই সঙ্গে অষ্টাঙ্গ আয়ুর্বেদের পূর্ণ পাঠও শেষ করেছিলেন৷ দুজনের কেউই জানতেন না, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে তাঁদের মধ্যে, এক প্রজন্মের তফাতে৷ দুরারোগ্য অ্যানথ়্রাক্সে বিস্তর ভুগে দাদু কোনক্রমে প্রাণ নিয়ে বেঁচেছিলেন নানার আপ্রাণ সেবায়৷ ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি যখন যমের সঙ্গে লড়াই করছেন, নিকট কুটুমরা এক কড়াও সাহায্য করেননি, ছোঁয়াচে রুগিকে আশ্রয় দেয়া তো দূর অস্ত! সমস্ত গয়না বিক্রি করে দাদুকে তিনি নিশ্চিত মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরিয়ে আনেন৷ এসব কথা বাবা জ্যেঠার কাছে পরে শুনেছি৷

যে দাদুকে আমার মনে আছে তিনি মিতবাক কিন্তু স্বভাবে রসময়, এবং অনেক বিষয়ে আশ্চর্য পন্ডিত৷ সেযুগেও ডাক্তারদের মধ্যে পলিম্যাথ়ের সংখ্যা হাতে গোনা; তিনি ছিলেন সেই বিরল প্রজাতির একজন৷ দাদু তখন মুরারই, নসিপুরে ইত্যাদি প্রত্যন্ত জায়গায় ডাক্তারি করেন; সেখানে তাঁর ছেলেরা কষ্ট করে, জলকাদা ভেঙে, বিস্তর হেঁটে স্কুলে যেতেন; বিকল্প ছিল হাতি — বুয়ার পক্ষে দুষ্কর সেই দুস্তর পদাতিক বৃত্তি৷ তাই আমার পিসি স্কুলে পড়েননি কখনও৷ দাদু নিজেই তাঁকে পড়াতেন, বিদ্যাদানের জন্যই পড়াতেন এবং নিজের বিদ্যাদানের ক্ষমতা ছিল বলেই, কারণ পাশ করানোর তাগিদ ছিল না কোনও৷ প্রাইভ়েটে স্কুল পাশ করে বুয়া কলেজে ভর্তি হন, পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ. করেন৷ আমার এক দিদি, নমিতাদি, নানা দাদুর কাছে থেকেই কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত; তাকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়াতেন দাদু৷ ডাক্তারি বিদ্যের বাইরের বিদ্যা তো ছিল বটেই৷ নমিতাদি জনান্তিকে আমার কাছে আক্ষেপ করে বলত,  “মেজদামনি প্রফেসরদের ওপর এক কাঠি!”

শুনেছি, কিছু অন্যায় বাতিক ছিল তাঁর, কিছু যুগ ও সমাজোপযোগী গোঁড়ামি, কিন্তু অন্য দিকে অনেক মুক্ত মনের মানুষের চেয়ে বেশি খোলামেলা মনে হত তাঁকে৷ বুড়োকাকা যখন বিজয়া পিসিকে বিয়ে করে, পয়োগ্রাম বাড়িতে ছীছিৎকার ও শোকের আবহ তখন নানা দাদুই ছিলেন তাদের পেছনে৷ সেটা দ্বন্দ্বের যুগ, নতুনের সঙ্গে পুরনোর, হিন্দুত্বের সঙ্গে ব্রহ্মবাদিত্বের, দমনের সঙ্গে নারীমুক্তির৷ আমি তাঁর বিচারের অধিকারী নই, এত যুগ পরে বিচারের দরকারই বা কি? যে দাদুকে আমি দেখেছি, তিনি নাকের ডগায় পুরু পরকলার চশমা লাগিয়ে বারান্দার রোদে পিলগ্রিম’স প্রোগ্রেস পড়ছেন, অথবা সেই কোন সত্য যুগের বাঁধানো স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজ়িন, দুটিই বহুপঠনে জীর্ণ; নিম্নাঙ্গে মালকোঁচা মারা ধুতি, শীতকালে পরনে একটা ছোট হাতার পাশবোতাম ফতুয়া, গ্রীষ্মে খালি গায়ে মার্জিত উপবীত৷ আমি মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম তাঁর, তাঁর অন্তিম নিজে দেখো, নিজে শোনো  উপদেশ উপেক্ষা করার কে?

তার আগেই অবশ্য এই দুনিয়ার ক্যালাইডোস্কোপে উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছি নিজে নিজেই৷ তাতেই কাল হল আমার৷ নজরটা তীক্ষ্ণই ছিল; অনেক গুরুজন আমার নজরদারির অভ্যেস ভালো মনে নিতেন না — অভিভাবকদের কাছে নালিশ যেত৷ তাইতে আমার নজর ছুটল মাঠেঘাটে, পথচলতি লোকজনের দিকে এবং গুরুজনদের নীরব নিরীক্ষণে৷

বারো কোয়ার্টারের ছোট মাঠের উত্তর-পশ্চিমে দুটো ঝোপের পাশে অনেকটা খালি জায়গা ছিল, আমাদের সদর থেকে তেরছা করে৷ তার একটা চৌখুপিতে একবার কেউ উৎসাহভরে ভুট্টা লাগিয়েছিল৷ লাগোয়া আরেকটা চৌখুপিতে কেষ্টকে দিয়ে বাবা লাগিয়েছিলেন সূর্যমুখী — বোস কাকা বলেছিলেন, “তার চেয়ে কি একটা কিচেন গার্ডেন ভালো হত না, এ.কে.?” বাবা নিজেই একেকদিন পোকা বাছতেন, মায়ের সেলাই বাক্সের আলিগড় কাঁচিটা নিয়ে পোকা ধরা পাতা, পুঁয়ে পাওয়া ডাল ছেঁটে দিতেন সযত্নে৷ আর পাঁচটা সূর্যমুখীর চেয়ে অনেক বড় সাইজ়ের ফুলের মেলা বসে গেল শেষকালে: প্রায় চায়ের পিরিচের মত বড়, ভ্যান গহ্-র সূর্যমুখীর মত, ব্লেকের বাঘের মত উজ্জ্বল হলুদ৷ ভুট্টার শিসেও তখন রস এসেছে — রথের মেলার আগেই তোলা দরকার৷ দেখতে দেখতে একদিন পঙ্গপালের মত একঝাঁক খাটিয়ে কিন্তু আমুদে টিয়া নেমে এলো দুটো চৌখুপিতেই, অবিশ্বাস্য পান্না রঙের, মারামারি করলনা, ঝগড়া ঝাঁটিও নয়৷ কেষ্টমালি ছাতা নিয়ে হুশ হুশ বলার আগেই সমান ভাগে আহার করে উড়ে গেল অন্যত্র৷ পরের দিনও পুনরাবৃত্তি৷ বুঝলাম, তারা মানুষের মত আমার আমার  রোগে ভোগে না৷

খোকাদার কাছে কাজ করত চিত্তদা, মা বলতেন, “চটপটে, চালাক চতুর, আমাদের হরির মত নয়৷” আমার একটা ট্রাইসাইকেল জুটেছিল, বড়দের সাইকেলের মত চেন-স্প্রকেটওয়ালা — বিদায়ী কোনও সাহেবের থেকে কেনা৷ সেটা নতুন চালাতে শিখছি যখন, চিত্তদা দেখি অফ টাইমে মাঞ্জা দিয়ে বেরুবার জন্য প্রস্তুত৷ আমাকে শুধালো, “বাজারের দিকে যাচ্ছি, তুমি যাবে?” অমনি আমি দু প্যাডেলে খাড়া! আমরা খোশমেজাজে গল্প করতে করতে বাজার গেলাম, চিত্তদা সিগারেট লজেন্স আর লিলি বিশকুট খাওয়ালো৷ বেলা গড়িয়ে ফিরছি যখন, দেখি বাবা মা খোকাদা সহ দুনিয়ার লোক গেটের সামনে; পুলিসে খবর দেয়নি কেউ তখনও, সার্চ পার্টির প্ল্যান ছকছে সবে৷ সেটা বোধহয় আমার প্রথম একলা অ্যাডভেঞ্চর, একলা বলতে বাবা মা বা অন্য গুরুজন অথবা তাঁদের অনুমতি ছাড়া৷ আত্মপ্রসাদটা মাঠে মারা গেল যখন বুঝলাম চিত্তদার কাজ গিয়েছে আমার জন্য, আমাকে একটু সাবালক হতে সাহায্য করার জন্য৷ বুঝলাম, বড়রা কতটা নিষ্ঠুর হতে পারে, কতটা বেমরমী!

###

ক্রমশ

Other posts in <aniruddhasen.wordpress.com> and <apsendotcom.wordpress.com>